প্রাণের ৭১

একাত্তরের এই দিনে: উত্তাল ৫ মার্চঃ মোহাম্মদ হাসান

উত্তাল ৫ মার্চ। ১৯৭১ সালের এই দিনে দেশজুড়ে চলছিল মিছিল-মিটিং-বিক্ষোভ। সময় যত গড়াচ্ছিল মুক্তিকামী জনতার আন্দোলন ততই অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছিল। আন্দোলনে-মিছিলে পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর গুলি সত্ত্বেও দমে যায়নি বীর বাঙালি।

তাদের চোখে-মুখে ছিল শুধুই স্বাধীনতার স্বপ্ন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগের মধ্য দিয়ে আন্দোলন এগিয়ে যায় স্বাধীনতার অবশ্যম্ভাবী ও যৌক্তিক পরিণতির দিকে। ১৯৭১ সালের এই দিনে ৫ম দিনের মতো হরতাল পালনকালে সশস্ত্র বাহিনী সদস্যদের গুলিতে টঙ্গী শিল্প এলাকায় ৪ জন শ্রমিক শহীদ এবং ২৫ জন আহত হন।

এ খবরে ঢাকায় মানুষের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। সন্ধ্যায় সরকার ঘোষণা দেয়, আজ ঢাকায় সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে হরতালের মধ্যেই ব্যাংক খোলা থাকে। মসজিদে মসজিদে জুমার নামাজের পর শহীদদের আত্মার শান্তি কামনা করে বিশেষ মোনাজাত করা হয়। ঢাকাসহ সারা দেশে প্রতিবাদ সভা ও শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়।

লাহোরেও দেশের পূর্বাঞ্চলের সাম্প্রতিক আন্দোলনে শহীদদের গায়েবানা জানাজা হয় এবং সংকটময় মুহূর্তে দেশের সংহতির জন্য বিভিন্ন মসজিদে বিশেষ মোনাজাত করা হয়। পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জেডএ ভুট্টো রাওয়ালপিণ্ডির প্রেসিডেন্ট ভবনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে ৫ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে আলোচনা করেন।

অবসরপ্রাপ্ত এয়ার মার্শাল আসগর খান বিকালে করাচি থেকে ঢাকায় আসেন। তিনি রাতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার ধানমণ্ডির বাসভবনে সাক্ষাৎ করেন। রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিদেশি বেতারে প্রচারিত ‘শেখ মুজিব, ভুট্টোর সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে রাজি আছেন’ এ সংক্রান্ত সংবাদকে ‘অসদুদ্দেশ্যমূলক’ ও ‘কল্পনার ফানুস’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।

বঙ্গবন্ধুর স্বাধিকার আন্দোলনের আহবানে সাড়া দিয়ে বিকালে কবি-সাহিত্যিক ও শিক্ষকরা মিছিল নিয়ে রাজপথে নেমে আসেন। ছাত্রলীগ ও ডাকসুর উদ্যোগে বায়তুল মোকাররম থেকে মিছিল বের হয়।

১১ দফা আন্দোলনের অন্যতম নেতা তোফায়েল আহমদ ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দান থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সরাসরি রিলে করার জন্য ঢাকা বেতার কেন্দ্রের প্রতি আহবান জানান। রাতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদ বিবৃতিতে বলেছেন, ঢাকা চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, রংপুর সিলেটসহ বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানে সেনা সদস্যদের বুলেটে নিরস্ত্র মানুষ, শ্রমিক, কৃষক ও ছাত্রদের হত্যা করা হচ্ছে।

এভাবে নির্বিচারে মানুষকে হত্যা করা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ছাড়া আর কিছুই নয়। রাওয়ালপিণ্ডিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে পিপলস পার্টির প্রধান জেডএ ভুট্টোর আলোচনা বৈঠক শেষে পার্টির মুখপাত্র আবদুল হাফিজ পীরজাদা মন্তব্য করেন, জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখার পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়া যেভাবেই বিচার করা হোক না কেন, তা অত্যন্ত অবাঞ্ছিত এবং আদৌ যুক্তিযুক্ত নয়।

এদিকে বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনের ডাক এবং স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠের পর নড়েচড়ে বসে পিণ্ডির শাসকগোষ্ঠী। ৫ মার্চ সারা দেশ থেকে মুক্তিকামী জনতার ওপর পাকিস্তানিদের লেলিয়ে দেয়া পুলিশ বাহিনীর গুলিবর্ষণের খবর আসতে থাকে। আসতে থাকে মৃত্যু সংবাদ। কিন্তু ঘাতকের বুলেট মৃত্যুর মিছিল বাড়িয়ে দিলেও রুখতে পারেনি মুক্তিকামী বাঙালির উত্তাল আন্দোলন।

বাঙালির উত্তাল ও অপ্রতিরোধ্য দুর্বার আন্দোলনে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ভিত নড়ে ওঠে। নিরীহ মানুষের ওপর গুলিবর্ষণ থেকে শুরু করে সব ধরনের অত্যাচার-নির্যাতনের মাত্রা বাড়লেও দমেনি বাংলার প্রতিবাদী মানুষ। – সংগৃহীত।






মতামত দিন।

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*