প্রাণের ৭১

নির্বাচনী রাজনীতি ।। গনতন্ত্রে’র পথে নয়,ষড়যন্ত্রে’র পথে চলছে!!

নির্বাচনী রাজনীতি ॥ গণতন্ত্রের পথে নয়, ষড়যন্ত্রের পথে চলছে!!
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী।।

বিদেশে বসবাসের অনেক অসুবিধার মধ্যে একটা বড় সুবিধা এই যে, দেশের পরিস্থিতির দিকে একটু দূরে বসে লক্ষ্য রাখলে এমন সব ঘটনা জানা যায়, যা কাছে বসে জানা সহজ নয়। অনেক নির্মোহ দৃষ্টিতেও ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণ করা যায়। এই যে একজন নারী সাংবাদিক সম্পর্কে অশোভন মন্তব্য করে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন বিপাকে পড়লেন, প্রথমে মনে হয়েছিল এটা চায়ের কাপে তুফান। কিন্তু নিজের অশোভন মন্তব্যের জন্য ব্যারিস্টার মইনুল ক্ষমা চেয়েও রেহাই পেলেন না। মামলা মোকদ্দমায় জড়িয়ে শেষ পর্যন্ত গ্রেফতার হলেন, বিদেশে বসে এর অনেক নেপথ্য কাহিনীও জানতে পেরেছি। এর সত্য মিথ্যা জানি না। কিন্তু যা একেবারে একটি সহজ ঘটনা মনে হয়েছিল তা দেখছি ততটা সহজ ঘটনা নয়। বিচারাধীন বিষয়, তাই মন্তব্য করছি না। সত্যের ঢাক আপনিই বাজবে।

একটা বিষয় স্পষ্ট, একটি সাধারণ নির্বাচনের আগে দেশের পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে উঠছে। আওয়ামী লীগ সরকারকে নির্বাচনে হারিয়ে ক্ষমতা থেকে অপসারণের চেষ্টা কোন অন্যায় বা অগণতান্ত্রিক পন্থা নয়। দেশে এই উদ্দেশ্যে যদি বিএনপি-জামায়াত জোট প্রস্তুতি গ্রহণ করত কিংবা তার বাইরে অন্য কোন দল বা তৃতীয় জোট উদ্যোগী হতো তাহলে আপত্তির কিছু ছিল না। বরং বলা যেত দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া স্বাভাবিক পথে চলছে।

ড. কামাল হোসেন, ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী এবং আরও কয়েকটি ছোট বড় দল মিলে যখন আওয়ামী লীগ বিরোধী তৃতীয় জোট গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয় তাকেও দেশের নির্বাচনমুখী রাজনীতিতে স্বাগত জানানো যেত। কিন্তু কয়েকটি ব্যাপার হঠাৎ পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করে তোলে এবং একটি সাধারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশে গণতন্ত্রের রাজনীতি নয়, ২০০১ সালের চাইতেও গভীর এক ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু হয়েছে বলে সন্দেহ করার কারণ ঘটে। বিদেশে বসে এই সত্যটা আমার চোখে আরও বেশি ধরা পড়েছে।

প্রথম কথা, ড. কামাল হোসেনের জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া ও ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর যুক্তফ্রন্ট মিলে নতুন জোট গঠন করার উদ্যোগ, তার পাঁচ দফা কর্মসূচী ঘোষণা এবং সাফ বলে দেয়া বিএনপি যদি জামায়াতের সংশ্রব ছাড়ে তাহলেই এই জোটে যোগ দিতে পারে এ পর্যন্ত সবই ভাল ছিল। কিন্তু হঠাৎ এই কর্মসূচী ঘোষণার প্রথম বৈঠকেই সদলবলে ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর অনুপস্থিতি এবং ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের এই বৈঠকে অকস্মাৎ আবির্ভাব এবং একেবারে ড. কামাল হোসেনের পাশে অবস্থান গ্রহণ অনেকের মনে সংশয় সৃষ্টি করে।

দ্বিতীয় কথা, এক এগারোর আধা সামরিক সরকারের মন্ত্রীপদ থেকে অপসারিত হওয়ার পর দীর্ঘকাল ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের কোন রাজনৈতিক তৎপরতা ছিল না। এক এগারোর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে তাকে এই সভায় ডাকার কথাও ছিল না। তার একটি সাইনবোর্ডসর্বস্ব রাজনৈতিক দলও নেই। তাহলে তিনি কাদের ডাকে বা কোন দলের প্রতিনিধি হয়ে ঐক্য প্রক্রিয়ার সভায় এলেন? কেবল কি নিজের প্রতিনিধি হয়ে এবং ঐক্য প্রক্রিয়ার কারও গোপন আমন্ত্রণে?

এই প্রশ্ন দুটোর সুরাহা না হতেই ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে বাদ দিয়ে ঐক্যফ্রন্ট গঠনের ষড়যন্ত্রটি ধরা পড়ে যায়। এই ব্যাপারে লন্ডনে বসে তারেক রহমান যে খেলা খেলেছেন তা জানতে আমার দেরি হয়নি। তারেক চেয়েছেন বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে ঠেকিয়ে ড. কামাল হোসেনকে বিএনপি-জামায়াত জোটে টেনে আনা। তিনি জানেন জামায়াতের বিরুদ্ধে ড. কামালের অবস্থান খুবই দুর্বল। তবে চক্ষুলজ্জায় তিনি সরাসরি তার গণফোরাম নিয়ে বিএনপি-জামায়াত জোটে যোগ দিতে পারবেন না। তাকে দিয়ে ঠুঁটো জগন্নাথের মতো একটি ঐক্যফ্রন্ট বানিয়ে বিএনপি-জামায়াত জোটের সঙ্গে যুক্ত করলে যে নামই এই সংযুক্তিকে দেয়া হোক এটা হবে বিএনপি-জামায়াত জোটে আরেকটি শরিকের সংযোজন।

ডা. বদরুদ্দোজাকে সঙ্গে নিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হলে এবং তাতে যোগ দিতে হলে বিএনপিকে জামায়াতের সংশ্রব ছাড়তে হতো। তারেক রহমান ও খালেদা জিয়া আদালতের বিচারে দ-িত। তারা বিএনপির নেতৃত্বে থাকতে পারেন না। ঐক্যফ্রন্টে আসতে হলে এই নেতৃত্বও তাদের বদল করতে হতো। তাই বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে এই ঐক্যফ্রন্ট থেকে বাদ দেয়ার চক্রান্ত লন্ডনেই শুরু হয়।

দীর্ঘদিন ধরে সাংবাদিকতা করছি, অতীতের অনেক রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের কাহিনী আমার জানা। তাই আমার ইনটিউসন বলে, ঐক্যফ্রন্ট গঠনের নামে বর্তমানের চক্রান্তের রাজনীতিতেও নিজের জ্ঞাতসারে হোক আর অজ্ঞাতসারে হোক ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন ব্যবহৃত হয়েছেন। তাকে এই চক্রান্তে ব্যবহারের জন্য যদি তার ‘প্রিয় মামা’ বিএনপির সিনিয়র আইনজীবী খোন্দকার মাহবুবেরও নেপথ্য ভূমিকা থাকার প্রমাণ পাওয়া যায় তাহলে আমি বিস্মিত হব না। লক্ষ্য করার বিষয়, ঐক্যফ্রন্ট গঠনের আলোচনার নামে আমন্ত্রণ জানিয়ে ডা. বদরুদ্দোজাকে ড. কামালের বাসায় এনে বসিয়ে রেখে ড. কামাল হোসেনকে ব্যারিস্টার মইন নাকি আ স ম আবদুর রব ও মাহমুদুর রহমান মান্নার সহযোগিতায় তার অফিসে এনে (প্রকারান্তরে আটকে রেখে) ড. চৌধুরীকে বাদ দিয়ে ঐক্যফ্রন্ট গঠনের কাজ শেষ করেন এবং বিএনপি-জামায়াত জোটের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হন।

এই খবরটা আমার নয়, ঢাকার কাগজেরই খবর। সেজন্যেই প্রশ্ন ওঠে, দল নেই বল নেই ব্যারিস্টার মইনুল একা একজন মানুষ হয়ে এতটা প্রভাব খাটালেন কি করে? এবং খাটালেন কাদের সহযোগিতায় ও কাদের স্বার্থে? ঐক্যফ্রন্ট গঠনের প্রথম প্রকাশ্য সভায় তার আকস্মিক আবির্ভাব থেকে নারী সাংবাদিককে অবমাননার অভিযোগে তার গ্রেফতার পর্যন্ত সব ঘটনাটাই কি এক সূত্রে গাঁথা? এ সম্পর্কে আলোচনার সময় এখনও আসেনি।

দেশের বর্তমান ঘোলাটে পরিস্থিতির আসল সত্যটি কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ বলেছে, ‘কামাল হোসেন তৃতীয় জোট গঠন না করে নিজেই বিএনপি-জামায়াত জোটে যোগ দিয়েছেন।’ আমার ধারণা, বেগম খালেদা জিয়া জেলে এবং তারেক রহমান বিদেশে থাকায় বিএনপিতে যে নেতৃত্ব শূন্যতা দেখা দিয়েছে তা কাটিয়ে ওঠার জন্য বিএনপি নেতারা তাদের জোটের প্রক্সিনেতা হিসেবে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্ব মেনে নিয়েছেন। তারা জানেন, ড. কামালের নিজস্ব কোন কনস্টিটিয়ুন্সি নেই। তার পায়ের তলায় রাজনীতির শক্ত মাটিও নেই। তার প্রয়োজন ফুরালেই তারেক রহমান তাকে বৈরাম খাঁ বানিয়ে শুধু রাজনীতি নয়, দেশ ছাড়া করতে পারবেন।

তবে এই অন্ধকারের মধ্যেও আমি একটু আলোর ইশারা দেখছি। চানক্যবুদ্ধির অধিকারী তারেক রহমান বিদেশে বসে হয়তো ভাবছেন বাংলাদেশের রাজনীতিতে কামাল হোসেন এখন আর কোন ফ্যাক্টর নন। তিনি অবশ্যই রাজনৈতিক এতিম। তাকে সামনে খাড়া করে বর্তমানের সঙ্কট উত্তীর্ণ হতে পারলে ভবিষ্যতে ব্যবহৃত কমলার খোসার মতো তাকে আঁস্তাকুড়ে ফেলে দিয়ে দলে তার একক নেতৃত্ব ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠা ঠেকায় কে? কিন্তু এর বিপরীত ঘটনাও কি বিএনপিতে ঘটতে পারে না?

আগামী নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট সুবিধা করতে না পারলে আদালতের বিচারে দ-িত অপরাধী হিসেবে বেগম জিয়া বা তারেক রহমানের বিএনপির নেতৃত্ব ধরে রাখা সম্ভব হবে না। বিএনপির একদল তারেক বিরোধী নেতাকর্মী সেই আশাই করছেন। তারা আশা করছেন আগামী নির্বাচনে বিএনপি সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দল হবে এবং তাদের নতুন নেতা নির্বাচন দরকার হবে। আইনগত কারণেই বেগম জিয়া কিংবা তারেক রহমান নেতা হতে পারবেন না। তখন নতুন নেতা নির্বাচনেও তাদের সম্মতি দিতে হবে।

তার ফলে কি ড. কামাল বিএনপির নতুন নেতা নির্বাচিত হবেন? সে আশাতেও গুড়ে বালি। তিনি এবারেও নির্বাচনে দাঁড়ালে নির্বাচিত হবেন কিনা সন্দেহ। বিএনপির নতুন পার্লামেন্টারি নেতা হিসেবে যিনি নির্বাচিত হয়ে আসবেন, আশা করা যায় তিনি এবং দলটির কোণ্ঠাসা দেশপ্রেমিক নেতাকর্মীরা মিলে দলটিকে অভিশপ্ত নেতৃত্বের কবলমুক্ত করে গণতান্ত্রিক রাজনীতির পথে ফিরিয়ে আনবেন। এটাকেই আমি অন্ধকারে আলোর ইশারা বলছি।

গণতান্ত্রিক বিরোধিতার বদলে শেখ হাসিনাকে নির্বাচন সামনে নিয়ে আবারও ষড়যন্ত্রের রাজনীতির মোকাবেলা করতে হচ্ছে। উপায় নেই, যে যা-ই বলুক তাকে আরও কঠোর হতেই হবে। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় একবার অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হককে বলেছিলেন, ‘ফজলুল হক, তোমার মতো একজন জনপ্রিয় রাজনীতিকের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বড় ব্যর্থতা কি জানো? তুমি মায়ের হৃদয় নিয়ে দেশ শাসন করতে চাও। মায়ের হৃদয় নিয়ে দেশ শাসন করা চলে না।’

শেখ হাসিনা এই কথাটা থেকে শিক্ষা নেবেন আশা করি। তিনিতো মায়ের হৃদয় নিয়ে দেশ শাসন করে দেখেছেন তার ফল কি দাঁড়ায়! দেশের স্বার্থ ও গণতন্ত্রের স্বার্থেই তাকে আরও কঠোর হতে হবে।






মতামত দিন।

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*