প্রাণের ৭১

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষিত থাকবে লাল-সবুজের অপ্রতিরোধ্য চিহ্নকে বুকে জড়িয়ে প্রতিটি বাঙালির জীবনবোধে।

৩০ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে প্রাপ্ত লাল-সবুজের অপ্রতিরোধ্য চিহ্নকে নিয়েই পরাজিত পাকী আত্মার যত রকমের আত্মগ্লানি মিশে আছে আর সেই অপ্রতিরোধ্য চিহ্নকে সরাতে পারলেই এদের যাপিত গ্লানিবোধটুকু ধুয়েমুছে সাফসুতরো হয়ে যায়। তাই, এসব পাকী আত্মায় বেঁচে থাকা কীটপতঙ্গরূপী মনুষ্য প্রজাতিগুলো নিজেদের জাত চেনাতে ঘাপটি মেরে বসে আছে শুধু পাপনের মতো কিছু অর্বাচীনের অপেক্ষায়। অথচ, তার বাবার ইতিহাস আর মায়ের আত্মা এ জাতির জন্য গর্বের বিষয়।

৭৫’র এর পরবর্তী পরিস্থিতিতে ৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে সংগঠিত জেনোসাইড থেকে শুরু করে যুদ্ধ চলাকালীন সময়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা কিংবা স্মৃতিচিহ্ন সংবলিত জায়গা সমূহ আমাদের রাজনৈতিক দৃঢ়তার অভাব কিংবা উদাসীনতার সুযোগে বেহাত হয়ে গেছে। দিনে দিনে সেসব স্থানে এমন কিছু স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে যা স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস সংবলিত কোনকিছুই যেন উপস্থিত না থাকে এবং মানুষের মন থেকে মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটা ভুলিয়ে দিতে পারলেই বাঙালির জীবনবোধ পাল্টে ফেলতে সময় লাগবেনা আর তাই এ জাতির সংস্কৃতি ও ইতিহাস ভুলে যেতে কখনো ধর্মের ব্যবহার শুরু হয়ে যায় কিংবা অর্থনৈতিক সুবিধা কাজে লাগিয়ে স্বাধীনতার পক্ষের লোকজনকে ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন খোঁড়া যুক্তি দিয়ে তাতে নিজের পৈতৃক ইতিহাস কিংবা ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হলে-ও স্বপ্ন দেখানো হয় তুমি কেন আধুনিক সুযোগ সুবিধা পাবেনা?

একটা জাতির গর্ব করার মতো কিছু ইতিহাস থাকে যা দিয়ে নিজেদের আত্মমর্যাদা বোধ ঠিক করা হয় প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম কিন্তু সেই ইতিহাস মুছে দেয়া বা ভুলিয়ে দিতে পারলেই কেবলমাত্র জাতিকে বিভ্রান্ত করে মেরুদণ্ডহীন বা নাম পরিচয়হীন গোত্রে রূপান্তরিত করা সম্ভব। ৫২ থেকে ৭১এ যেহেতু বাঙালির জীবনবোধের রূপান্তর ঘটেছে সেহেতু পরাজিত শক্তির মূল টার্গেটই দাঁড়িয়েছে যে, হেরে গেছি তাতে কি তোমাদের ইতিহাসই ভূলিয়ে দেবো যাতে পরবর্তী প্রজন্মের সামনে গর্ব করার মতো কিছু না থাকে আর আমাদের পূর্ব প্রজন্মের অপরাধে নিজের পরিচয় প্রকাশিত না হয়।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে জেনারেল জিয়ার অধিন পুতুল সরকার থেকে নিজের ক্ষমতা গ্রহণের পর স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিকে শুধু নিজের মন্ত্রীসভায় জায়গায়ই দেয়নি বরং সেই ক্ষমতাকে একচেটিয়া ধরে রাখতে স্বাধীনতা বিরোধীদের প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটাকেও ভুলিয়ে দিতে বা কলংকিত করতে যা যা করা লাগে তার সবরকমই চেষ্টা করে গেছে। সংবিধান থেকে স্বাধীনতার মূলনীতি বা উদ্দেশ্য মুছে ফেলতে ধর্মকে উপজীব্য করেছে যা পরবর্তীতে এরশাদের হাতে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে প্রতিস্থাপন হয়েছে এবং শেষতক জিয়ার সহধর্মিণী খালেদা জিয়ার মাধ্যমে রাজাকারদের পূনর্বাসন ও মন্ত্রীত্ব দিয়ে রাষ্ট্রের পতাকা তাদের গাড়ীতে তুলে দেওয়া হয়েছে আর এখন তো তার কুলাঙ্গার সন্তান তারেক জিয়া সময়ে-অসময়ে প্রথম প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে বঙ্গবন্ধুর নামে যা তা বলছে। এমনকি মা-ছেলে মিলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় ত্রিশ লক্ষ শহীদ ও বুদ্ধিজীবীদের নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করছে যা সেই পরাজিত শক্তির এজেন্ডা এবং আপাতদৃষ্টিতে ধোয়াশার মধ্যে জাতিকে নিপতিত করার সুক্ষ্ম ষড়যন্ত্রের নীলনকশা বললেও ভুল হবেনা।

বিগত দশবছরের অধিক সময়ে আওয়ামী লীগের সরকার দেশ চালাচ্ছে যা তাদের ইতিহাসের রেকর্ড বলা যায় এবং এই দলটিই নেতৃত্ব দিয়ে বাঙালী জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটিয়েছে বলা যায় এবং প্রতিটি বাঙালী সে হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ বা যে ধর্মেরই লোক হোক না কেন তার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই বরং আমরা সবাই বাঙালি এই জাতীয়তাবাদ তৈরির মাধ্যমে বিভাজনের পথ বন্ধ করে দিয়েছে। অথচ, আজ সেই দলটি ক্ষমতায় থাকলেও ধর্মের নামে একটি বিশেষ পক্ষ জাতিকে বিভাজনের চেষ্টা করে যাচ্ছে এবং স্থানীয় পর্যায়ের বিভিন্ন নেতাকর্মী থেকে জাতীয় পর্যায়েরও কেউ কেউ সেখানে প্রভাব বিস্তারে ভূমিকা রাখছে যা দল হিসাবে আওয়ামী লীগের জন্য অশনিসংকেত। কারণ, রাষ্ট্র বা নেতৃত্ব যা বলছে তার বাহিরে দলীয় নির্দেশনাকে উপেক্ষা করেই কেউকেউ নিজস্ব মতবাদে হাজির হয়ে সংখ্যালঘু, উপজাতি বা অন্যান্যের বিশ্বাসে আঘাত দেবার মাধ্যমে নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতির প্রভাবে এদের বেশিরভাগেরই কোনরকম বিচারের আওয়তায় আনার চেষ্টা করা হচ্ছে না। যদিও দুয়েকটা ঘটনার প্রতিবাদে নাগরিক সমাজ সোচ্চার হয়ে উঠলেই কেবল উপরমহল নড়েচড়ে বসছেন যা দুঃখজনক।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওয়তায় আনতে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আদালত গঠন থেকে শুরু করে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন ও যুদ্ধাপরাধের মামলায় বেশকিছু যুদ্ধাপরাধী নেতার বিচার করায় আওয়ামী লীগের ব্যপক সমর্থন থাকলেও একটা পর্যায়ে তা ঝিমিয়ে পড়েছে বলা যায়। প্রগতিশীল দাবিদার জনগণের চাহিদা পূরণে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব কতটুকু সফল তা বলা মুস্কিল। কারণ, বেশকিছু বিতর্কিত সিদ্ধান্তঃ উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী খুশি হলেও প্রগতিশীলদের পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন। ইতিমধ্যেই হেফাজতের দাবিদাওয়া মেনে পাঠ্যবইয়ে বা স্কুল কলেজের বিভিন্ন পুস্তকে ব্যপক রদবদল আনা হয়েছে যা আওয়ামী শাসনামলে কেউ কামনা করেনি, এমনকি হেফাজত ইসলাম বা ধর্মভিত্তিক সংগঠন ও দলসমূহের মতো বিরোধী দলের কেউই কল্পনা করতে পারেনি এটুকুন বলা যায় নিশ্চিত।

আওয়ামী লীগের কিছুকিছু মন্ত্রী বা এমপির কার্যক্রম দেখলে মনে হয় দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতির কোন প্রয়োজন নেই মানে ৪৮ বছর আগেকার ঘটনাদি ভুলে গেলেই ভাল হয় তাতে নিজেদের মতো আরেক পক্ষকে খুশি করার মাধ্যমে নিজের জনপ্রিয়তা ও আখের গোছাতে সুবিধা হবে। বহির্বিশ্বের রাজনীতির পাঠপ্রতিক্রিয়ার সঙ্গে এদের কোনোই সম্পর্ক নেই বরং ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়ার চেয়ে বর্তমান বাস্তবতায় সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ সহজ কিন্তু এরা ইরান বা আফগানিস্তান থেকে কোনো শিক্ষা নিতে অপারগ। দেশ দুটোর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় প্রগতিশীল নাগরিকদের বেশিরভাগই তৎকালীন নেতৃত্বের উদাসীনতা ও অবহেলার বিরুদ্ধে তথাকথিত মোল্লাদের উত্থানকে সমর্থন করেছিলো এবং বামাদর্শও প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়ে ক্ষমতায় এনেছিল কিন্তু ক্ষমতায় এসে অল্প ক’দিনে সেই বামদের ও চিহ্নিত প্রগতিশীলদের কচুকাটা করে পথের কাটা সাফ করেছিল। যাহোক অতীত ভুলে বর্তমান ইতিহাস তো কমবেশি সকলের জানা। সুতরাং দুধকলা থুক্কু জায়গা জিরত দিয়ে আগাছাকে অর্থাৎ রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর মোল্লাতন্ত্রের সহযোগিতা করলে কি পরিস্থিতিতে পড়তে হতে পারে তা সহমত ভাই দাবিদার চবর্গীয়দির ভাইয়েরা সময় থাকতে বুঝবেনা।

মৌলবাদী গোষ্ঠী খুব ভাল করেই জানে যে, বাঙালির জীবনবোধে যতদিন নিজস্ব সংস্কৃতি ও ইতিহাস জড়িত থাকবে ততদিন বাংলার মাটিতে তাদের অস্তিত্বের জয়গান সহজ হবে না। তাই নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে পহেলা বৈশাখ থেকে প্রতিটি উৎসবকে ধর্মের কাঁটাতারে আবদ্ধ করতে সচেষ্ট হয়েছে। কারণ, সাধারণ মুসলমান যেহেতু ধর্মীয় আবেগকে সম্মান করে সেহেতু ইসলামের দৃষ্টিতে খারাপ বলে বিবেচিত যেকোনো কাজকে এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করে শুধুমাত্র প্রকৃত জ্ঞানের অজ্ঞতায়। অথচ, আরব থেকে আগত ধর্মের নিজস্ব সংস্কৃতি এখনো চলমান আছে। প্রতিবছর সৌদি আরবসহ পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রসমূহে জাঁকজমকপূর্ণ প্রদর্শনীর মাধ্যমে নববর্ষসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালিত হয় কিন্তু আমাদের দেশের প্রতিক্রিয়াশীল স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি জামাত-শিবিরের দোসর হেফাজতের দালালদের কাছে পহেলা বৈশাখ থেকে প্রতিটি উৎসব হিন্দুদের আচরিক ধর্ম বলে বিতর্কিত করতে ধর্মের নামে অধর্ম বা অপরাধ করে থাকে। এমনকি আমাদের মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নিহত বীরদের সম্মানে পালিত অনুষ্ঠানকেও ধর্মীয় ব্যাখ্যায় ভিন্নচোখে দেখার তাগাদা দিচ্ছে কিন্তু রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল কোন ব্যক্তি বা বাহিনীর সদস্যরা সেটাকে চ্যালেঞ্জ করার সাহস দেখাতে সাহস পাচ্ছে না। মোল্লাগো তলোয়ারের কোপে ঘাড় ঘুরিয়ে অলিখিত একটা চুক্তির মাধ্যমে ইতিহাস ও সংস্কৃতির অনুষ্ঠানাদি পালিত হয়, যেনো তোমার কর্ম তুমি করে যা-ও আর আমাদেরটা আমরা করে দায়িত্ব শেষ করি অর্থাৎ উভয় পক্ষই উইন উইন সিচুয়েশনে আছে এটুকুই বলা যায়। অথচ, ভাষার জন্য আত্মত্যাগের গর্বিত ইতিহাসকে আজকে সারাবিশ্বে মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটা সংরক্ষিত থাকবে লাল-সবুজের অপ্রতিরোধ্য চিহ্নকে বুকে জড়িয়ে এটা প্রতিটি স্বাধীনতাকামী প্রগতিশীল ও দেশপ্রেমিক জনগণের চাহিদা যা রাষ্ট্রকে অবশ্যই পূরণ করতে হবে আর তা করতে ব্যর্থ হলে আজ যেভাবে প্রতিবাদ হচ্ছে ঠিক আগামীকাল কোন বিদ্রোহের শুভসূচনা হবে এইটুকুন বলতে হবে না বরং এ জাতির সংস্কৃতি ও ইতিহাস আছে নিজস্বতার যোগে নতুনভাবে ইতিহাসকে রচনা করার। তাই যতদিন বাঙালী সত্তা হাজির থাকবে ততদিন ইতিহাস ও ঐতিহ্য রক্ষার তাগিদে প্রতিটি বাঙালির কন্ঠে প্রতিধ্বনিত হবে লাল-সবুজের অপ্রতিরোধ্য চিহ্নের জয়গান।।

লিখেছেন

মোয়াজ্জেম হোসেন তারা

অনলাইন এক্টিভিস্ট, ফ্রান্স।



(পরবর্তি সংবাদ) »



মতামত দিন।

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*