প্রাণের ৭১

ইউরোপে ভ্যাকসিন সংকটের কারণ সরবরাহ নয়

ছবি: সংগৃহীত

করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন উদ্ভাবনে ইউরোপ প্রধান ভূমিকা রাখলেও মহাদেশটির বাসিন্দারা এখন ঠিকমতো ভ্যাকসিন পাচ্ছে না। স্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও রাজনীতি নিয়ে গভীর সংকটে পড়তে যাচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। মহামারিতে বেশির ভাগ ইউরোপীয় অর্থনীতি এখন স্থবির। তার ওপর আক্রান্ত ব্যক্তি, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগী এবং এতে মৃতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।

ইউরোপের চাহিদামতো ভ্যাকসিন উত্পাদিত হচ্ছে কি না সেটি দেখার দায়িত্ব ইউরোপিয়ান কমিশনের। মহামারির শুরুর দিকে কমিশনকে পুরো ইইউর জন্য ভ্যাকসিন তৈরির কাজটি তত্ত্বাবধান করতে বলা হয়েছিল। এত বিশাল পরিসরে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা কমিশনের আগে ছিল না। যে কারণে প্রথমদিকে কমিশন ওষুধের পরিবর্তে কর্মসংস্থান তৈরির দিকে বেশি মনোযোগ দেয়। সেখানে ১০০ বছরের মধ্যে এত কঠিন পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়নি। ওষুধ কিনতে ইইউ পাইকারিভাবে কেনার কথা চিন্তা করে। কারণ এটি একটি বিশাল জোট, এর দর কষাকষি করার সামর্থ্য যে কোনো সংস্থার চেয়ে বেশি।

 

বাস্তবে ধারণাটি খুব একটা কাজ দেয়নি। কারণ এ সময়ে দ্রুত সরবরাহকে অগ্রাধিকার দেওয়াই ছিল সময়ের দাবি। তবে সম্ভাব্য সংক্রমণ ঠেকানো গেলে এবং ইইউ অর্থনীতি আগেভাগে খুলে দিলে যে পরিমাণ ব্যয় সাশ্রয় হতো ভ্যাকসিন কম দামে সংগ্রহের চেয়ে বেশি তা অধিক লাভজনক ছিল। সব মিলিয়ে ইইউ বা ইউরোপীয় কমিশন দোটানায় ছিল, ফলে সুলভে ভ্যাকসিন সংগ্রহের সুযোগ হাতছাড়া হয়। যুক্তরাজ্য বা ইসরাইলের মতো ইইউর বাইরে থাকা দেশগুলো এই সুযোগে কোম্পানিগুলোর সঙ্গে সহজে দর কষাকষি করে ভ্যাকসিন সরবরাহ নিশ্চিত করেছে।

ফাইজার-বায়োনটেক এবং আস্ট্রাজেনেকা ইউরোপের জন্য তাদের পণ্য কাঙ্ক্ষিত পরিমাণের চেয়ে কম পাঠায়। বিষয়টি ইউরোপীয় নেতৃবৃন্দের জন্য হতাশাব্যঞ্জক। এর প্রতিক্রিয়ায় ইউরোপিয়ান কমিশন ওষুধ প্রস্তুতকারীদের রপ্তানি রিপোর্ট জমা দিতে বলেছে। কমিশনকে না জানিয়ে কোনো ওষুধ মহাদেশের বাইরে পাঠানো যাবে না বলেও নির্দেশনা দিয়েছে। কিন্তু ইইউ ভুলে যায় যে তাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার আগে ফাইজার-বায়োনটেক ও আস্ট্রাজেনেকা ইউরোপের বাইরের দেশগুলোর সঙ্গে চুক্তি করে। আগেই বলা হয়েছে, ইইউর সঙ্গে সেরকম চুক্তি হয়নি। ইউরোপীয় জোট দর কষাকষি করার শক্তি নিয়ে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী ছিল। এখন ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠানগুলো ইউরোপের বাইরের দেশগুলোর সঙ্গে যে সব চুক্তি করেছে তা মেনে চলতে বাধা সৃষ্টি করছে ইইউ।

 

ভ্যাকসিন সাপ্লাই চেইন একটি জটিল বিষয়। ইউরোপের ভ্যাকসিনের কাঁচামাল এসেছে ইউরোপের বাইরে থেকে। ইইউ ইউরোপের বাইরে ভ্যাকসিন পাঠাতে বাধা দিলে ভবিষ্যত্ কাঁচামাল সংগ্রহ করতে সমস্যা হবে। কাঁচামাল সংগ্রহ করতে অসুবিধা হলে সংগত কারণে পুনরায় উত্পাদন ও সরবরাহ লাইনে বিলম্ব হবে। ফলে ইউরোপে করোনাজনিত মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তেই থাকবে। অনেকে মনে করে ইইউর উচিত ছিল ঐ পথে না গিয়ে ভ্যাকসিন যা হাতে এসেছে তা ঠিকমতো বণ্টনের ওপর মনোযোগ নিবদ্ধ করা। এতে করে ভবিষ্যতের বড় জটিলতা এড়ানো যেত। ২১ ডিসেম্বর ইইউ ভ্যাকসিন অনুমোদনের পর এক মাসের বেশি পার হলেও এ কাজে ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে সমন্বয় পরিলক্ষিত হচ্ছে না।

ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে মাল্টা ও ডেনমার্কই ভ্যাকসিন কর্মসূচিতে এগিয়ে আছে। ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশ দুটো ইইউ কোটা ও তার বাইরে নিজস্ব প্রচেষ্টায় সংগৃহীত ভ্যাকসিন ব্যবহার সম্পন্ন করেছে। এই সময়ের মধ্যে ইইউ ও নরওয়ে মিলিয়ে ভ্যাকসিন কর্মসূচি বাস্তবায়নের হার ৫৭ শতাংশ। এ সময়ের মধ্যে ৬৫ ঊর্ধ্ব জনগোষ্ঠীর মাত্র ৭ শতাংশ কর্মসূচিটির আওতায় আনা সম্ভব হয়। ইইউ দেশগুলোর ভৌগোলিকভাবে ভৌগোলিক অবস্থানও সবাইকে ভ্যাকসিন কর্মসূচি বাস্তবায়নের পথে একটি অন্তরায়।

জনসংখ্যার ঘনত্বও সব দেশে একরকম নয়। ডেনমার্কের জনসংখ্যা মোটামুটি একটি স্থানে বিস্তৃত। তাই সেখানে ভ্যাকসিন কর্মসূচি সফল হয়েছে। এ কারণে মহাদেশটির নাজুক জনগোষ্ঠীর বড় অংশ রয়ে গেছে ভ্যাকসিন কর্মসূচির বাইরে। যেহেতু ভ্যাকসিন দুই ডোজ দেওয়ার নিয়ম তাই যাদের ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে তাদের ডাটাবেজ সংরক্ষণ করা গুরুত্বপূর্ণ। অধিকাংশ ইউরোপীয় দেশকে এক্ষেত্রে এখনো ফ্যাক্সের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। কারণ প্রত্যন্ত এলাকায় বসবাসকারী সবাইর তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের সমান সুযোগ নেই। এই মহামারি দেখিয়ে দিয়েছে, ইউরোপ দেশগুলো তথ্যপ্রযুুক্তি ও স্বাস্থ্যসেবা খাতে এতদিন যথেষ্ট মনোযোগ দেয়নি।

মহামারির জন্য ইউরোপে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থমকে রয়েছে মাসের পর মাস। এখন ভ্যাকসিন সংকট পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে। এমনকি মহাদেশের রাজনীতির ওপরও পড়তে পারে এর নেতিবাচক প্রভাব। কারণ সাধারণ মানুষের মনে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, এ বছরের অর্ধেক সময় এভাবে কেটে যেতে পারে।






মতামত দিন।

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*