প্রাণের ৭১

করোনা যুদ্ধে সুশাসনের অভাব: টিআইবি এক কোটি ১০ লাখ ফোন কলে পরীক্ষা মাত্র পাঁচ লাখ!

করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সরকারের গৃহীত কার্যক্রমে সুশাসনের প্রতিটি নির্দেশকের ক্ষেত্রে ব্যাপক ঘাটতি লক্ষ করা গেছে বলে অভিযোগ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। ‘করোনাভাইরাস সংকট মোকাবেলায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে এ অভিযোগ করে হয়। প্রতিবেদনে করোনা মোকাবেলা কার্যক্রমে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরা হয়। গতকাল সোমবার টিআইবি কার্যালয়ে ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এ রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে প্রারম্ভিক বক্তব্য দেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।

গবেষণার পর্যবেক্ষণে বলা হয়, দীর্ঘ সময় ধরে পরিকল্পনাহীনতা, সুশাসনের ঘাটতি ও অপ্রতুল বাজেট বরাদ্দের কারণে স্বাস্থ্য খাতের দুর্বল সক্ষমতা করোনার সংকটে উন্মোচিত হয়েছে। সরকার কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন কার্যক্রমে পরিকল্পনা ও সমন্বয়ের ঘাটতি প্রকটভাবে লক্ষ করা গেছে। চীন দেশে করোনার প্রাদুর্ভাবের পর তিন মাস সময় হাতে পেয়েও তা মোকাবেলায় পর্যাপ্ত প্রস্তুতি গ্রহণ না করায় এবং সুশাসনের ঘাটতির কারণে দেশ ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে। একদিকে প্রস্তুতিহীনতা, সমন্বয়হীনতা ও অব্যবস্থাপনার কারণে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের অনুপ্রবেশ চিহ্নিতকরণ ও নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা; অন্যদিকে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও পরীক্ষাগারের সম্প্রসারণ না করে বিপুলসংখ্যক মানুষকে পরীক্ষার আওতার বাইরে রাখা এবং কঠোরভাবে চলাচল নিয়ন্ত্রণ না করার কারণে সংক্রমণ সারা বাংলাদেশে বিস্তার লাভ করেছে। লকডাউনসহ সব ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ মতামত উপেক্ষা করে আমলানির্ভর সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রবণতা লক্ষ করা গেছে।

করোনা পরীক্ষার দুরবস্থার চিত্র তুলে ধরে বলা হয়, জাতীয় কলসেন্টার ও আইইডিসিআরের নির্ধারিত হটলাইনে ১৪ জুন পর্যন্ত প্রায় এক কোটি ১০ লাখ ফোন কল এলেও সেই তুলনায় পরীক্ষার সংখ্যা খুবই কম (প্রায় পাঁচ লাখ)। বর্তমানে মাত্র ২১টি জেলায় পরীক্ষার সুবিধা রয়েছে। এই গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত জেলা পর্যায়ের হাসপাতাল থেকে সংগৃহীত তথ্যে দেখা যায়, মাত্র ৪১.৩ শতাংশ হাসপাতাল নিজ জেলা থেকেই পরীক্ষা করাতে পারে, বাকি ৪৮.৭ শতাংশ হাসপাতালে সংগৃহীত নমুনা পরীক্ষার জন্য বিভাগীয় শহরে বা ঢাকায় পাঠাতে হয়। করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ ও প্রতিবেদন দিতে কখনো কখনো আট থেকে ১০ দিন পর্যন্ত বিলম্ব হচ্ছে। সমস্যার কারণে গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ৫৭ শতাংশ হাসপাতাল প্রয়োজনের চেয়ে অর্ধেক সংখ্যক পরীক্ষা করাতে বাধ্য হচ্ছে।

 

গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত হাসপাতালগুলোর ৭৪.৫ শতাংশেই দক্ষ জনবলের ঘাটতি লক্ষ করা যায়। এ ছাড়া বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক (৫১.১%), প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি (৫৯.৬%) নিম্নমানের সুরক্ষা সামগ্রী (৫১.১%) ইত্যাদি বিষয়ে সক্ষমতার ব্যাপক ঘাটতি ছিল। গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত হাসপাতালগুলোর ৫৩ শতাংশে করোনার প্রভাবে সাধারণ চিকিৎসাসেবায় ব্যাঘাত ঘটছে, যার মধ্যে ৭১ শতাংশ হাসপাতাল জানিয়েছে, নিম্নমানের সুরক্ষা সামগ্রী সরবরাহের কারণে অনেক স্বাস্থ্যকর্মী সেবা দেওয়া থেকে বিরত থাকছেন বা আক্রান্ত হচ্ছেন। ফলে তাদের এই সেবা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ১১ জুন ২০২০ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ঔষধাগার দেশে প্রায় ২৩ লাখ পিপিই বিতরণ করেছে বলে দাবি করেছে। এই দাবি অনুযায়ী প্রত্যেক স্বাস্থ্যকর্মীর (প্রায় ৭৫ হাজার) কমপক্ষে ৩০ সেট সুরক্ষা সামগ্রী পাওয়ার কথা থাকলেও অনেক স্বাস্থ্যকর্মী এখনো একটিও পাননি বলে হাসপাতাল থেকে তথ্য পাওয়া গেছে। গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত হাসপাতালগুলোর প্রায় ২৫ শতাংশের সব চিকিৎসক এবং ৩৪ শতাংশের সব নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী পিপিই পাননি বলে জানিয়েছেন।

গবেষণাটি মিশ্র পদ্ধতিনির্ভর—গুণবাচক ও পরিমাণবাচক এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উভয় ধরনের তথ্য এ গবেষণায় ব্যবহার করা হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। নিঃসম্ভাবনা বা সুবিধাজনক নমুনায়নের মাধ্যমে সারা দেশের সব বিভাগের মোট ৩৮টি জেলার ৪৭টি জেলা পর্যায়ের হাসপাতাল থেকে স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কিত তথ্য এবং ৪৩টি জেলা থেকে স্থানীয় নাগরিকের (সাংবাদিক, শিক্ষক, পেশাজীবী) কাছ থেকে ত্রাণ বিতরণের প্রত্যক্ষ তথ্য অনলাইন চেকলিস্টের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়েছে। এ ছাড়া টেলিফোনে মুখ্য তথ্যদাতার (চিকিৎসক ও সাংবাদিক) সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে করোনা মোকাবেলায় টিআইবির ১৫টি সুপারিশ উত্থাপন করা হয়েছে।






মতামত দিন।

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*