প্রাণের ৭১

খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র পদপ্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেক বড় ব্যবধানে বিজয়ী হয়েছেন

 

কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র পদপ্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেক বড় ব্যবধানে বিজয়ী হয়েছেন। তবে প্রতিপক্ষ বিএনপি বলেছে, এই নির্বাচনে ভোট ডাকাতি হয়েছে। ভোটকেন্দ্রগুলোতে প্রভাব বিস্তার ছাড়াও কারচুপি ও জাল ভোট প্রদানের অভিযোগ এনেছে তারা। বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু বলেন, ‘সরকারি দল ভোট ডাকাতির নির্বাচন করেছে।’ তিনি শতাধিক ভোটকেন্দ্রে পুনরায় ভোটগ্রহণের দাবি জানিয়েছেন। এদিকে নির্বাচন কমিশন খুলনায় শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার দাবি করেছে।

মোট ২৮৯টির মধ্যে ২৮৬টি কেন্দ্রের ঘোষিত ফলে নৌকা প্রতীকে ভোট পড়েছে এক লাখ ৭৬ হাজার ৯০২টি আর ধানের শীষ প্রতীকে ভোট পড়েছে এক লাখ আট হাজার ৯৫৬টি। এর ফলে আওয়ামী লীগের তালুকদার আবদুল খালেক বেসরকারিভাবে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। অনিয়মের অভিযোগে বাকি তিনটি কেন্দ্রে ভোট স্থগিত করার কথা জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এ নির্বাচনে মোট পাঁচজন প্রার্থী মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। অন্য তিনজন হলেন কাস্তে প্রতীক নিয়ে সিপিবির মিজানুর রহমান বাবু, লাঙল প্রতীক নিয়ে জাতীয় পার্টির শফিকুর রহমান মুশফিক ও হাতপাখা নিয়ে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মাওলানা মুজাম্মিল হক।

খুলনা সিটি করপোরেশনে (কেসিসি) গতকাল মঙ্গলবারের এই নির্বাচনে তালুকদার খালেক হারানো মসনদ পুনরুদ্ধার করলেন। এর আগে ২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত তিনি কেসিসির মেয়র ছিলেন। ২০১৩ সালের নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থী মনিরুজ্জামান মনির কাছে প্রায় ৬১ হাজার ভোটের ব্যবধানে হেরে যান তিনি। আওয়ামী লীগের এবারের জয়ের পেছনে নগরীর ব্যাপক উন্নয়নকাজ মূল ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করছেন অনেকে। নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু তাঁর দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কারাবাসের ঘটনা সামনে এনে ভোটারদের সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা করেন। ভোটারদের ধানের শীষে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেছিলেন, বিএনপি প্রার্থী জয়ী হলে খালেদা জিয়ার মুক্তি ত্বরান্বিত হবে। তালুকদার খালেকের প্রতিশ্রুতি ছিল, তিনি নির্বাচিত হলে অসমাপ্ত উন্নয়নকাজ শেষ করবেন।

ভোটগণনার পর্যায়ে গত রাত সাড়ে ৮টার দিকে তালুকদার খালেকের জয়ের আভাস পেয়ে আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকরা নগরীর বিভিন্ন স্থানে রাস্তায় নেমে পটকা ফুটিয়ে উল্লাস করতে থাকে।

ভোটগ্রহণ স্থগিত তিন কেন্দ্রে : নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগে তিনটি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়। এগুলো হলো ইকবালনগর সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, রূপসা বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও ৩১ নম্বর ওয়ার্ড কার্যালয়। এ ছাড়া ফাতিমা স্কুল কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত করার পর আবার ভোট নেওয়া হয়।

রূপসা মাধ্যমিক স্কুল কেন্দ্রে দুপুর ১২টার পর ব্যালট পেপার না থাকায় ভোটাররা ভোট দিতে পারেনি। ভোট স্থগিত হওয়া ইকবালনগর মাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে দায়িত্ব পালনকারী একাধিক সদস্য কালের কণ্ঠকে বলেন, সকাল ১১টার দিকে এই কেন্দ্রে ২০-২৫ জন যুবক জোর করে প্রবেশ করে। তারা কেন্দ্রের ৭ নম্বর বুথে প্রবেশ করে ব্যালট পেপার নিয়ে সিল মেরে ভোট বাক্সে ফেলতে থাকে। সাড়ে ১১টার দিকে কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার খলিলুর রহমান কেন্দ্রে ভোট স্থগিতের ঘোষণা দেন। একাধিক এজেন্ট জানান, যেসব যুবক এসেছিল তাদের সবার গায়ে নৌকা প্রতীকের ব্যাজ লাগানো ছিল। তারা এসেই প্রার্থীদের এজেন্টদের বের হয়ে যেতে বলে। এরপর ব্যালট পেপার নিয়ে নৌকা প্রতীকে এবং আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীর ঠেলাগাড়ি ও সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদের গ্লাস প্রতীকে ভোট দিয়ে তা বাক্সে ভরে। প্রিসাইডিং অফিসার খলিলুর রহমান কালের কণ্ঠকে জানান, তিনি পুলিশের সহযোগিতা নিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। তবে পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করেছে কি না, তিনি তা জানেন না। দুপুর ১২টার দিকে ওই কেন্দ্রে আসেন রিটার্নিং অফিসার ইউনুচ আলী। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, এই কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে। সব ব্যালট পেপার জব্দ করা হয়েছে।

দুপুর ১২টার সময়েই ৩০ নম্বর ওয়ার্ডে রূপসা বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে ব্যালট পেপার শেষ হয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। অভিযোগ ওঠে, ধানের শীষ প্রতীকের এজেন্ট বের করে দিয়ে একদল যুবক ওই কেন্দ্রে প্রবেশ করে ব্যালট পেপারে সিল মেরে ব্যালট বাক্সে ফেলে। এই কেন্দ্রে নির্বাচন পরিচালনার সঙ্গে থাকা একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, সকাল সাড়ে ১১টার দিকে একদল যুবক কেন্দ্রে ঢুকে ধানের শীষ প্রতীকের এজেন্টকে বের করে দেয়। এরপর তারা ব্যালট পেপার কেড়ে নিয়ে সিল মেরে বাক্সে ভরে। দুপুর ১২টার দিকে ভোটাররা ভোট দিতে কেন্দ্রে এলে তাদের বলা হয়, ব্যালট পেপার শেষ হয়ে গেছে। ব্যালট পেপার আনতে লোক পাঠানো হয়েছে। কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার মো. ইবনুর রহমান বলেন, ‘কেন্দ্রে কিছু বহিরাগত এসে জাল ভোট দেওয়ার চেষ্টা করে। ওই সময় একটি অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। যে কারণে ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়।’

নগরীর ২২ নম্বর ওয়ার্ডের ফাতেমা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ সাময়িক স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছিল। পরে আবার ভোট গ্রহণ করা হয়। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ভোটগ্রহণ বন্ধ ঘোষণা করেন প্রিসাইডিং অফিসার জিয়াউল হক।

এ ছাড়া খুলনা সিটি কলেজ কেন্দ্র, পাইওনিয়ার বালিকা বিদ্যালয় কেন্দ্র, কয়লাঘাটা প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দে  ভোট দিতে আসা একাধিক ভোটার ভোট দিতে পারেনি বলে অভিযোগ করে। কেউ কেউ বলে, তাদের কিছু লোকের সামনেই সিল মারতে বলা হয়েছে। কাউকে বলা হয়, ‘আপনার ভোট দেওয়া হয়ে গিয়েছে।’

সকাল ৮টা থেকে ভোটগ্রহণ শুরু হয়ে বিকাল ৪টা পর্যন্ত চলে। কেন্দ্রগুলোতে সকাল থেকেই ভোটাররা জড়ো হতে থাকেন। বেশ উত্সবের মেজাজেই ভোটগ্রহণ শুরু হয়। তবে ১০টার দিকে বিএনপি মনোনীত মেয়র প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু অভিযোগ করেন, অনন্ত ৪০টি কেন্দ্র থেকে তাঁর এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়েছে। এজেন্টদের মারধর করা হয়েছে। তিনি জানান, ২২, ২৫, ৩০ ও ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে পোলিং এজেন্টদের বের করে দেওয়ার ঘটনা ঘটে। ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের রূপসা স্কুল কেন্দ্রে ধানের শীষের এজেন্ট সেলিম কাজীকে মারধর করা হয়েছে। এ ছাড়া নগরীর বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে ধানের শীষের এজেন্টদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি। ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের হাজী আব্দুল মালেক ইসলামিয়া দাখিল মাদরাসার সামনের নির্বাচনী ক্যাম্প ভাঙচুর করা হয়েছে।

কেসিসি নির্বাচনে সংরক্ষিত ১০টি ওয়ার্ডে ৩৯ জন এবং ৩১টি সাধারণ ওয়ার্ডে ১৪৮ জন কাউন্সিলর প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। নির্বাচনে মোট ভোটার চার লাখ ৯৩ হাজার ৯৩ জন। এর মধ্যে পুরুষ দুই লাখ ৪৮ হাজার ৯৮৬ ও নারী দুই লাখ ৪৪ হাজার ১০৭ জন। ভোটকক্ষ এক হাজার ১৭৮টি। ভোটকেন্দ্র ও ভোটকক্ষে দায়িত্ব পালন করেন চার হাজার ৯৭২ জন কর্মকর্তা।

অভিযোগ প্রত্যাখ্যান আওয়ামী লীগের

বিএনপির ভোট কারচুপির অভিযোগ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ও কেসিসি নির্বাচনে তালুকদার খালেকের প্রধান নির্বাচন সমন্বয়কারী এম এম কামাল হোসেন বলেছেন, এসব অভিযোগ সঠিক নয়। জনগণ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে বিএনপি নির্বাচন কমিশন ও সরকারকে বিতর্কিত করতে এসব অভিযোগ তুলেছে। বিএনপি প্রার্থী প্রচারণার শুরু থেকেই এ রকম অভিযোগ করে আসছিলেন। কামাল হোসেন দু-একটি কেন্দ্রে অনিয়ম হওয়ার অভিযোগ স্বীকার করে বলেন, সেখানে নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসন ত্বরিত ব্যবস্থা নিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়।

সিপিবি মেয়র প্রার্থীর প্রতিক্রিয়া : সিপিবি মনোনীত প্রার্থী মিজানুর রহমান বাবু এক বিবৃতিতে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘিত হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন। তিনি বলেন, সকাল থেকেই এলাকায় সরকারদলীয় ছাড়া অন্য দলের এজেন্টদের দাঁড়াতে দেওয়া হয়নি। এলাকায় এলাকায় মহড়া, রিকশায় পোস্টার লাগিয়ে ভোটার পরিবহন ও মোড়ে মোড়ে জটলা করে সাধারণ মানুষের মনে ভীতি সঞ্চার করে তোলে। কয়েকটি এলাকায় ভোটকেন্দ্র দখল করে ব্যালট পেপারে সিল মারার খবর ছড়িয়ে পড়লে সাধারণ মানুষ ভোট প্রদানের আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসন সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। কোথাও কোথাও নির্বাচন কমিশনকে সরকারি দলের স্থানীয় নেতাকর্মীদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার অসহায় ক্রীড়নকে পরিণত হতে দেখা গেছে।

বিএনপির অভিযোগ প্রত্যাখ্যান

নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র দখল, জালভোট দেওয়ার যে অভিযোগ বিএনপি তুলেছে সেটা প্রত্যাখ্যান করেছেন খুলনার আওয়ামী লীগ নেতারা। দলটির কেন্দ্রীয় নেতা ও মেয়র পদপ্রার্থী তালুকদার আব্দুল খালেকের প্রধান নির্বাচনী সমন্বয়কারী এস এম কামাল হোসেন রাতে দলীয় কার্যালয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, খুলনায় শত শত সাংবাদিক, পর্যবেক্ষক কাজ করেছেন। কেউ নির্বাচনী কারচুপির কথা বলছেন না অথচ বিএনপি প্রার্থী অভিযোগ করছেন।






মতামত দিন।

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*