প্রাণের ৭১

দুই দেশের মধ্যে এমন সম্পর্ক বিশ্বে আর নেই, সাক্ষাৎকারে ভারতীয় হাইকমিশনার রীভা গাঙ্গুলি দাশ

সাকিবঃ ভারতীয় হাইকমিশনার রীভা গাঙ্গুলি দাশ প্রায় দুই দশক আগে কূটনীতিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে ঢাকায় এসেছিলেন। গত বছরের মার্চে ভারতীয় হাইকমিশনারের দায়িত্ব পালন করতে তিনি ঢাকায় আসেন। প্রায় ১৭ বছরের বিরতিতে বাংলাদেশে আসার পর এখানকার পরিবর্তন তাঁকে মুগ্ধ করেছে। ঢাকায় দায়িত্ব পালন শেষে শিগগির তিনি দিল্লিতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ পদে যোগ দিতে যাচ্ছেন। কোভিড-১৯ মহামারির সময় দুই দেশের সহযোগিতা, তিস্তা চুক্তি, সীমান্ত হত্যা, ঋণচুক্তির বাস্তবায়ন, রোহিঙ্গা সমস্যা, দুই দেশের সম্পর্কের ভবিষ্যৎসহ সম্পর্কের নানা বিষয় নিয়ে তিনি কথা বলেছেন প্রথম আলোর কূটনৈতিক প্রতিবেদক রাহীদ এজাজের সঙ্গে। ভারতীয় হাইকমিশনারের বাসায় ৩ আগস্ট সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয়।

প্রথম আলো: করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো ভারতসহ পুরো দক্ষিণ এশিয়ার ওপর জীবন ও অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপট থেকে অভূতপূর্ব এই চ্যালেঞ্জ ভারত কীভাবে মোকাবিলা করছে?

রীভা গাঙ্গুলি দাশ: কোভিড-১৯ মহামারির কারণে ভারত, বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব এখন এক অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। স্বাস্থ্যের ওপর গুরুতর চ্যালেঞ্জ তো বটেই, বিশ্বের প্রায় সব দেশের অর্থনীতি, বিশেষ করে সারা পৃথিবীর সরবরাহব্যবস্থাকে মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত করেছে কোভিড-১৯। প্রত্যেকেই এর প্রভাবটা বুঝতে পারছেন। জীবন আর জীবিকা—এর মধ্যে কোনটা আগে, বিভিন্ন দেশের সরকারকে এ নিয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। কোভিড-১৯ ছোবল হেনেছে ভারতেও। সমগ্র ভারতবর্ষে এর প্রভাব পড়লেও সরকার নীতিগত কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর ফলে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের শুরুতেই দ্রুততার সঙ্গে চূড়ান্ত কিছু পদক্ষেপ নিতে পেরেছে সরকার। এসব পদক্ষেপের ফলে ভারতে মৃত্যুহার কম রাখা আর সুস্থতার হার বাড়ানোর মতো বিষয়গুলো নিশ্চিত করা গেছে। মূলত নমুনা পরীক্ষা, কন্টাক্ট ট্রেসিং আর কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ—এই তিন স্তম্ভের ভিত্তিতে ঠিক করা হয়েছে ভারতের কোভিড-১৯ মোকাবিলার কৌশল।

যুদ্ধাবস্থায় যেমনটা হয়ে থাকে, অনেকটা সেভাবেই ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য সরকারগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে ব্যাপকভাবে স্বাস্থ্য অবকাঠামো গড়ে তুলেছে। কমিউনিটি সেন্টার, হোটেল আর বৃহদায়তনের স্থানগুলোকে সৃজনশীল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কোভিড-১৯ সেবাদান কেন্দ্রে রূপান্তর করার মাধ্যমে হাসপাতালের শয্যা ও নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ানো হয়েছে।

এই মহামারির শুরুতে পিপিই সংকটে থাকা দেশ থেকে পরবর্তী কয়েক মাসের মধ্যে পিপিই কিট রপ্তানির কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে ভারত। দেশের অভ্যন্তরে কিটের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ার ফলে নমুনা পরীক্ষা অনেক গুণ বেড়েছে। আইসিএমআর এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজি সহযোগিতায় ভারত বায়োটেকের উৎপাদিত ভারতীয় টিকা কোভ্যাক্সিনের ট্রায়াল এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, টিকা চালু হলে উৎপাদনকারীদের পছন্দের তালিকায় থাকবে ভারতীয় টিকা। ভারতে বিপুল জনগোষ্ঠী থাকার পরও সুস্থতার হার প্রায় ৬৫ দশমিক ৭৭ শতাংশ, যা সংখ্যায় প্রায় ১২ লাখের মতো। ভারতের আক্রান্ত লোকের সংখ্যা পাঁচ লাখের কাছাকাছি থাকছে। আর সারা বিশ্বে মৃত্যুহার যেখানে পাঁচ শতাংশ, ভারতে এই হার মাত্র ২ দশমিক ১ শতাংশ।

কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই ভারত অভূতপূর্ব এই মানবিক ও অর্থনৈতিক সংকটের মোকাবিলায় সক্রিয়ভাবে কাজ করে চলেছে। জীবন আর জীবিকার সুরক্ষায় গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনা নামের পৃথিবীর সবচেয়ে বড় খাদ্য নিরাপত্তা প্রকল্প চালু করেছে ভারত। এর লক্ষ্য সমাজের ঝুঁকিপূর্ণ লোকজনের পুষ্টির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। শুরুতে প্রায় দেড় ট্রিলিয়ন রুপির তহবিল, পরে ২০২০-এর নভেম্বর পর্যন্ত তা বাড়িয়ে ২১ ট্রিলিয়ন রুপির অর্থনৈতিক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে, যেখানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখা এবং জনগণের সামর্থ্য বাড়াতে নীতিগত সংস্কার ও অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচি যুক্ত করা হয়েছে। এমন এক জটিল সময়ে এসেও বন্ধু দেশগুলোর প্রতি হাত বাড়িয়ে দিয়ে নির্ভরযোগ্য ও দায়িত্বশীল রাষ্ট্র হিসেবে সারা বিশ্বে ভারতের ভূমিকা প্রশংসিত হয়েছে।

প্রায় ১৭ বছরের বিরতিতে দ্বিতীয়বারের মতো ঢাকায় কাজ করতে এসে আমি মুগ্ধ। কারণ, ঢাকা শহরের অর্ধেকটা আমি চিনতেই পারিনি। আগেরবার ধানমন্ডির যে জায়গাটায় আমি থাকতাম, সেটাই চিনতেই কষ্ট হচ্ছিল। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতির ছবিটা এসব পরিবর্তনে খুব স্পষ্ট।

প্রথম আলো: করোনাভাইরাসের বিস্তারের পরপরই মার্চে দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষ নেতাদের নিয়ে ভার্চ্যুয়াল কনফারেন্স করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি সার্কের জন্য একটি অভিন্ন তহবিল গঠন করে একসঙ্গে এই মহামারি মোকাবিলার উদ্যোগ নেন। বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলের দেশের জন্য কিছু সহায়তা দেওয়া হয়েছে অভিন্ন ওই তহবিল থেকে। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় শেষ পর্যন্ত সার্কের আওতায় ওই উদ্যোগ কতটা সফল হয়েছে?

রীভা গাঙ্গুলি দাশ: করোনাভাইরাস মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উদ্যোগে সার্ক নেতাদের এক ভিডিও কনফারেন্স গত মার্চ অনুষ্ঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এতে অংশ নেন। এই মহামারি মোকাবিলার তহবিলে ভারত প্রাথমিকভাবে ১০ মিলিয়ন ডলার দেওয়ার ঘোষণা দেয়। এর পরপরই বাংলাদেশ তহবিলে দেড় মিলিয়ন ডলার দেওয়ার ঘোষণা দেয়। তহবিল থেকে ২৫ মার্চ, ২৬ এপ্রিল এবং ৫ মে—এই তিন দফায় বাংলাদেশকে ৩০ হাজার সার্জিক্যাল মাস্ক, ১৫ হাজার হেড কাভার, ৫০ হাজার সার্জিক্যাল গ্লাভস, এক লাখ হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন ট্যাবলেট এবং ৩০ হাজার নমুনা পরীক্ষার জন্য আরটি-পিসিআর টেস্ট কিট দেওয়া হয়। এ ছাড়া আইটেক আয়োজিত অনলাইন কোর্সের মাধ্যমে উপকৃত হয়েছেন বাংলাদেশের চিকিৎসকেরা। এসব কোর্সের একটি ছিল বাংলায়, শুধু বাংলাদেশের চিকিৎসকদের জন্য।

২৩ মার্চ স্বাস্থ্যবিষয়ক কর্মকর্তাদের একটি ভিডিও কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে নিজেদের ভালো চর্চা ও অভিজ্ঞতা নিয়ে তাঁরা মতবিনিময় করেছেন। ৯ এপ্রিল এক ভিডি কনফারেন্সে যুক্ত হন সার্কের সদস্য দেশের বাণিজ্য কর্মকর্তারা। কোভিড-১৯–এর কারণে চলাচলে নিষেধাজ্ঞা এবং এর ফলে আন্তসীমান্ত বাণিজ্যের প্রভাব ও সরবরাহব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়ার বিষয়গুলো কীভাবে কাটানো যায়, তা নিয়ে তাঁরা আলোচনা করেন।করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবিলায় ভারতের দেওয়া চিকিৎসাসামগ্রীর দ্বিতীয় চালান গত ২৬ এপ্রিল বাংলাদেশকে হস্তান্তর করা হয়। ওই সামগ্রীগুলোর সামনে ভারতীয় হাইকমিশনার রীভা গাঙ্গুলি দাশ। ছবি: ভারতীয় হাইকমিশন

প্রথম আলো: করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রেক্ষাপটে দুই দেশের পূর্বপরিকল্পিত অনেক সফর, বৈঠক গত চার মাসে হতে পারেনি। এর ফলে দুই দেশের সম্পর্কে বিশেষ কোনো প্রভাব পড়েছে কি?

রীভা গাঙ্গুলি দাশ: আমি মনে করি, দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগ নিয়মিতভাবেই হচ্ছে। ফ্লাইট চলাচল বন্ধ থাকায় মুখোমুখি বৈঠক আমাদের মধ্যে হচ্ছে না, এটা ঠিক। তবে যে বিষয়গুলোতে নজর দেওয়া দরকার, সে বিষয়গুলো আমরা গুরুত্বের সঙ্গেই দেখছি। আমি নিজে ২৫টির বেশি ওয়েবনিয়ারে অংশ নিয়েছি। সরবরাহব্যবস্থায় যেভাবে বিঘ্নিত হয়েছে, তা কতটা কমানো যায়, এ নিয়ে দুই দেশের চেম্বার অব কমার্সের প্রতিনিধিরা নিজেদের নিবিড় আলোচনায় যুক্ত রেখেছেন।

করোনাভাইরাস সংক্রমণের পরপরই আমরা বাংলাদেশের বাণিজ্য, রেলপথ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, এসোচেম, এফআইসিসিআই, সিআইআই, এফবিসিসিআই, আইবিসিসিআই, চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিসহ বিভিন্ন অংশীদারত্ব সংস্থাকে যুক্ত করতে অনেকগুলো পদক্ষেপ নিয়েছি। এটা দ্রুত স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, কোভিড-১৯–এর কারণে বিঘ্নিত সরবরাহব্যবস্থা আর ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে হলে প্রচলিত চিন্তার বাইরে গিয়ে কাজ করার কোনো বিকল্প নেই। কয়েক দিনের মধ্যেই বাংলাদেশ রেলওয়ে ও ভারতের রেলওয়ে ভারতের বিভিন্ন অংশ থেকে পেট্রাপোল-বেনাপোল দিয়ে রেলপথে নির্বিঘ্নে পণ্য পরিবহন শুরু করে। এ ক্ষেত্রে প্রধান অগ্রাধিকার ছিল রোজার মাসে এবং ঈদের মৌসুমে বাংলাদেশে যেন নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর সরবরাহে ঘাটতি দেখা না দেয়। সম্প্রতি আমরা ট্রেনে করে মিনি ট্রাকও এনেছি। র‍্যাক আর মিনি র‍্যাকের সাফল্যের ধারাবাহিকতায় দুই দেশের রেলওয়ে সহযোগিতা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে পারসেল ও কনটেইনার ট্রেন সার্ভিস চালু করেছে।

বিদ্যমান চারটি রেল সংযোগ, পেট্রাপোল-বেনাপোল, রাধিকাপুর-বিরল, গেদে-দর্শনা আর রোহানপুর-সিংহাবাদ সীমান্তের দুই পাশে নির্বিঘ্নে কার্যক্রম পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। ৯ মে থেকে ২৪২টি পণ্যবাহী ট্রেনে করে পেঁয়াজ, মরিচ, আদা, চিনি, চালের বীজ, হলুদ, মসলাপাতি, কাগজ, ব্লিচিং পাউডার, ভুট্টা, সুতা, ডুপ্লেক্স পেপার, পাথর, ফ্লাই অ্যাশসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী ভারত থেকে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে। বিদ্যমান বিসিএন ওয়াগন ট্রেনের পাশাপাশি দুই দেশ পারসেল ট্রেন ও মূল্য সংযোজিত পণ্য পরিবহনের জন্য কনটেইনার ট্রেন চালু করেছে। এটি ব্যবসায়ীদের স্বল্প পরিমাণে এবং মূল্য সংযোজিত পণ্য আমদানি ও রপ্তানিতে সহায়তা করবে। প্রথম কনটেইনার ট্রেনে করে প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বেলের ৪০ কনটেইনার–বোঝাই এফএমসিজি পণ্য এবং অরবিন্দ ও বর্ধমান মিলের ১০টি কনটেইনার বাংলাদেশে পৌঁছেছে। এর পাশাপাশি টাটার ১১টি মিনি ট্রাক বাংলাদেশে এসেছে ট্রেনে করে। সংক্ষেপে আমরা বলতে পারি, ট্রেন ধীরে ধীরে আমাদের ব্যবসার ধরনটা বদলে দিতে শুরু করেছে। ক্ষুদ্র আমদানিকারকেরা এর যথেষ্ট সুফল পেয়েছেন। কারণ, তাঁদের পুরোপুরি নির্ভর করতে হতো স্থলবন্দরের ওপর। অথচ কোভিড-১৯–এর ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণে তাঁরা নানা রকম চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিলেন। এতে শুধু খরচের সাশ্রয় হচ্ছে না, মহামারির সময় যখন আমাদের স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়ে সচেতন থাকতে হচ্ছে, সে মুহূর্তে এভাবে পণ্য পরিবহন স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতার জন্যও সহায়ক।

রেলপথের সাফল্য নৌপথেও অনুসরণ করা হয়েছে। অভ্যন্তরীণ নৌপথে বাণিজ্য ও ট্রানজিট বিষয়ক প্রটোকলের (পিআইডব্লিউটিটি) দ্বিতীয় সংশোধনী ২০ মে সই হয়েছে। এর ফলে সোনামুড়া-দাউদকান্দি এবং রাজশাহী-গোদাগির-ধুলিয়ান থেকে আরিচা পর্যন্ত নতুন দুটি রুট এবং পাঁচটি নতুন পোর্ট অব কল যুক্ত হয়েছে। এতে পোর্ট অব কলের সংখ্যা বেড়ে এখন ১১–তে পৌঁছেছে, দুটি পোর্ট অব কলের পরিধি বেড়েছে আর পিআইডব্লিউটিটির রুট হয়েছে ১০টি। সম্প্রতি ৪৫টি কনটেইনারে করে ১ হাজার ১০০ টন স্পঞ্জ আয়রন পরিবহন করা হয়েছে, যা ৫৫টি ট্রাকে করে পণ্য পরিবহনের সমান। কলকাতার গার্ডেন রিচ থেকে পানগাঁওয়ের কনটেইনার টার্মিনালে সাত দিনের মধ্যে ওই পণ্য পরিবহন করা হয়েছে। কোভিড-১৯ আমাদের সামনে চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি নতুন সম্ভাবনার দুয়ারও খুলে দিচ্ছে।

চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর দিয়ে ট্রানজিট পণ্য পরিবহনের চুক্তির আওতায় প্রথম ট্রায়াল ১৬ জুলাই থেকে ২০ জুলাই সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

২০১৯ সালে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন এবং চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা ও সিলেটের সহকারী হাইকমিশন থেকে ১৬ লাখ ১৯ হাজার ভিসা দেওয়া হয়েছে। এটাই বিশ্বের যেকোনো দেশের ভারতীয় মিশন থেকে ইস্যু করা সর্বোচ্চসংখ্যক ভিসা। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসকারীদের জন্য ভারতীয় ভিসা সহজতর করতে ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশে নতুন ছয়টি ভারতীয় ভিসা আবেদন কেন্দ্র খোলা হয়েছে।

প্রথম আলো: গত এক দশকে দুই দেশের সহযোগিতা অনেক ক্ষেত্রে বিস্তৃত হয়েছে। মহাকাশ, পরমাণু, প্রতিরক্ষার মতো ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা শুরু হয়েছে। মাত্র ১০ বছরের মধ্যে প্রায় ৩০টি থেকে সহযোগিতা এখন ৬০টির বেশি ক্ষেত্রে সম্প্রসারিত হয়েছে। বহুমাত্রিক এই সহযোগিতাকে ভারত কীভাবে মূল্যায়ন করছে?

রীভা গাঙ্গুলি দাশ: আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যেমনটা বলেছেন, আমাদের দুই দেশের মতো নিবিড় ভ্রাতৃত্বমূলক সম্পর্ক পৃথিবীতে হাতে গোনা কয়েকটি দেশের মধ্যে আছে। সুপ্রতিবেশীমূলক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমাদের অংশীদারত্ব আজ এ অঞ্চলের জন্য মডেল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে দুই দেশ সম্পর্কের ‘সোনালি অধ্যায়’ রচনার প্রয়াস অব্যাহত রেখেছে। ভারত আর বাংলাদেশের উন্নয়নের চ্যালেঞ্জটা একই রকম। আর জনগণের জন্য উন্নত জীবিকার আকাঙ্ক্ষা অভিন্ন। আমাদের একে অন্যের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার, জ্ঞান বিনিময়ের এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতার সুযোগ রয়েছে। অভিন্ন ইতিহাস আর একই ধরনের মূল্যবোধের দুই নিকট প্রতিবেশীর জন্য এই ধরনের পারস্পরিক উন্নয়ন সহযোগিতা স্বাভাবিক বটে।

প্রথম আলো: গত এক দশকে দুই দেশের সম্পর্কের বড় অর্জনগুলোর মধ্যে স্থলসীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়ন বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো। অথচ তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি এখনো সই হলো না। সাম্প্রতিক সময়ে ভারত অববাহিকাভিত্তিক পানি ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দিচ্ছে। সে ক্ষেত্রে তিস্তা চুক্তি সইতে কি আরও সময় লাগবে?

রীভা গাঙ্গুলি দাশ: ২০১৫-তে সীমান্ত চুক্তির অনুসমর্থন দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি ঐতিহাসিক অর্জন। এ বছর তার পাঁচ বছর পূরণ হলো। জনগণের প্রয়োজনের বিষয়টিকে বিবেচনায় নিয়ে মানবিক প্রক্রিয়ায় আমরা এ সমস্যার সমাধান করেছি। সৎ উদ্দেশ্য ও পারস্পরিক আস্থা থাকলে যে সবচেয়ে জটিল সমস্যার সমাধান করা যায়, সীমান্ত চুক্তি সেটা প্রমাণ করেছে। তিস্তার পানিবণ্টনের বিষয়ে দ্রুত এবং পরস্পরের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি চুক্তি সইয়ের বিষয়ে ভারত অঙ্গীকারবদ্ধ। সীমান্তের দুই পারে বিষয়টি যে আবেগের, তা আমরা জানি। কিন্তু আমাদের অঙ্গীকার অটুট আছে। আমাদের কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা অনুযায়ী সব অংশীজনের ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি চুক্তি চূড়ান্ত হয়ে থাকে। তবে, এর মাঝখানে অভিন্ন অন্য নদীগুলোর পানি ভাগাভাগির বিষয়ে আমরা এগোতে পারি। এতে অগ্রগতি হলে আমাদের নিবিড় অংশীদারত্বের সুফল ভোগ করবে সীমান্তের দুই পাশের জনগণ।

প্রথম আলো: ঋণচুক্তির আওতায় এ পর্যন্ত বাংলাদেশকে আট শ কোটি ডলারের সহায়তা দিয়েছে ভারত, যা একক কোনো দেশকে দেওয়া সর্বোচ্চ সহায়তা। এক দশক আগে শুরু হওয়া ওই ঋণ চুক্তির বাস্তবায়ন ধীরে হচ্ছে বলা হয়ে থাকে। চুক্তি বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতাগুলো কী কী? এই সমস্যাগুলো সমাধানে দুই দেশ কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে? প্রতিরক্ষা সহযোগিতার আওতায় ভারত থেকে সমরাস্ত্র কিনতে ৫০ কোটি ডলার ঋণ পেয়েছে বাংলাদেশ। সমরাস্ত্র কেনাকাটায় শেষ পর্যন্ত কতটা অগ্রগতি হয়েছে?

রীভা গাঙ্গুলি দাশ: ভারতীয় ঋণচুক্তির (এলওসি) বাস্তবায়নে ধীরগতির বিষয়ে প্রতিবেদনগুলো তথ্যগতভাবে সঠিক নয়। বাস্তবায়নের বিষয়ে চূড়ান্ত মন্তব্য করার আগে ঋণচুক্তির প্রকল্পে অর্থছাড় এবং তা কীভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, এ বিষয়টি আমাদের নৈর্ব্যক্তিকভাবে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। নিজেদের উন্নয়ন আর অবকাঠামোর চাহিদার বিষয়টিকে বিবেচনায় নিয়ে শুরু থেকেই প্রকল্পগুলো নির্বাচিত করছে বাংলাদেশ। ২০১০-এ প্রথম এলওসি–তে ১৫টি প্রকল্পের জন্য ৮৬ কোটি ২ লাখ ডলার দেওয়া হয়। এরই মধ্যে ১২টি প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। ২০১৬–তে দ্বিতীয় এলওসিতে ১৫টি প্রকল্পের জন্য দুই শ কোটি ডলার দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। এর মধ্যে দুটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। বাকি ১৩টি প্রকল্প শেষ হওয়ার চূড়ান্ত ধাপে রয়েছে। ২০১৭-তে শেষ বা তৃতীয় এলওসিতে ১৬টি প্রকল্পে সাড়ে চার শ কোটি ডলার দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। এই প্রকল্পগুলো খসড়া প্রকল্প প্রস্তাবনা চূড়ান্ত করা, দরপত্র আহ্বান, দরপত্র শেষে কাজ দেওয়াসহ বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে। আর প্রতিরক্ষা নিয়ে ঋণচুক্তির বিষয়ে দুই পক্ষ আলোচনার বিভিন্ন পর্যায়ে আছে। এসব প্রকল্পে ভারতের দিক থেকে অর্থছাড়ের বিষয়ে আমি কোনো সমস্যা দেখছি না।

এলওসি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া কার্যকরভাবে সমন্বয়ের জন্য দুই পক্ষ একটি যৌথ এলওইসি পর্যালোচনাকাঠামো তৈরি করেছে। ওই কাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি আনার পাশাপাশি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোন বাধাগুলোর মুখোমুখি হতে হচ্ছে, তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট খাত ধরে আলোচনা শুরু করেছে। গত এক বছরে দুই দেশ এলওসি বাস্তবায়নের বিভিন্ন বাধা দূর করেছে। এর ফল শিগগিরই চোখে পড়বে।

পেট্রাপোল-বেনাপোল দিয়ে রেলপথে নির্বিঘ্নে পণ্য পরিবহন শুরু করে।…সম্প্রতি আমরা ট্রেনে করে মিনি ট্রাকও এনেছি। র‍্যাক আর মিনি র‍্যাকের সাফল্যের ধারাবাহিকতায় দুই দেশের রেলওয়ে সহযোগিতা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে পারসেল ও কনটেইনার ট্রেন সার্ভিস চালু করেছে।

প্রথম আলো: মাঝখানে গত কয়েক বছরে দুই দেশের সীমান্তে বাংলাদেশের নাগরিকদের মৃত্যুর সংখ্যা কমে এসেছিল। গত কয়েক মাসে তা আবার বাড়ছে। দুই দেশ সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনার অঙ্গীকার করেছে। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সমন্বিত যৌথ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা অনুযায়ী দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী কাজও করছে। তারপরও সীমান্তে মৃত্যু থামছে না। সীমান্ত হত্যা বন্ধে আর কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত?

রীভা গাঙ্গুলি দাশ: ভারত কিংবা বাংলাদেশ যেকোনো দেশের নাগরিকই হোক না কেন, ভারতীয় সীমান্তের অভ্যন্তরে যেকোনো একজনের মৃত্যুও দুর্ভাগ্যজনক। আমাদের দুই দেশের সীমান্ত সাধারণত শান্তিপূর্ণ থাকলেও সীমান্তের দুই পাশেই অপরাধীরা সক্রিয় রয়েছে। আমাদের দুই পক্ষের সমন্বিত সীমান্ত ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনার কার্যকারিতা, কাঁটাতারের বেড়া এবং বিএসএফ আর বিজিবির জোরালো সহযোগিতার কারণে সীমান্তের দুই পারের অপরাধীরা ইদানীং মরিয়া হয়ে উঠেছে। এর ফলে কাঁটাতারের বেড়া লঙ্ঘন আর বিএসএফের জওয়ানদের ওপর সহিংস হামলার সংখ্যাও বাড়ছে। ২০১৯-এ এক বিএসএফ জওয়ান নিহত ও অন্য ৮৩ জন আহত হয়েছে। ওই ঘটনাগুলোর সবগুলোই ঘটেছে ভারতের অভ্যন্তরে। বিশেষ করে রাতের অন্ধকারের সুযোগকে কাজে লাগায় দুই দেশের অপরাধীরা। বিএসএফ সদস্যদের ওপর হামলার ক্ষেত্রে চোরাকারবারিদের মধ্যে আজকাল দা, কাস্তেসহ ধারালো অস্ত্র আর দেশি বন্দুকের ব্যবহার বাড়ছে। গত বছর এ ধরনের হামলা হাত থেকে বাঁচতে গিয়ে বিএসএফের হাতে ১২ জন ভারতীয় নাগরিক মারা গেছেন। আর এ ধরনের দুর্ভাগ্যজনক ঘটনায় বাংলাদেশের নাগরিকদেরও প্রাণ গেছে।

জটিল এ বিষয়টি সমাধানের জন্য সীমান্ত এলাকার লোকজনকে আন্তর্জাতিক সীমান্ত আইন মেনে চলার অপরিহার্যতা সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে। যাতে তারা অবৈধ কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য ভারতের ভূখণ্ডে প্রবেশের ঝুঁকি নেওয়া থেকে বিরত থাকে। এর পাশাপাশি সীমান্তে যাতে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় থাকে, তা নিশ্চিত করার স্বার্থে বিএসএফ আর বিজিবিকে নিবিড় সমন্বয়ের নির্দেশনা দেওয়া উচিত।

প্রথম আলো: আন্তসীমান্ত অপরাধ কমাতে বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্তে ভারত কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের সবশেষ অগ্রগতি কী?

রীভা গাঙ্গুলি দাশ: ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের দৈর্ঘ্য ৪ হাজার ৯৬ দশমিক ৭ কিলোমিটার, যা বিশ্বের পঞ্চম দীর্ঘ সীমান্ত। দুই দেশের বন, নদী, গ্রাম এবং কৃষিজমির ওপর এই সীমান্ত বিস্তৃত। তাই দুই দেশের সীমান্তরক্ষীদের জন্য জটিল এই সীমান্তের ব্যবস্থাপনা যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং বটে। ভারত সরকার এরই মধ্যে প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছে। সীমান্তের বাকি অংশেও বেড়া নির্মাণের কাজ চলছে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, সীমান্ত চোরাকারবারি দলগুলো সীমান্তের যেসব ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা প্রতিনিয়ত ব্যবহার করে থাকে, কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার ফলে তা কমে আসবে। এর পাশাপাশি তা সীমান্তে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিতে সহায়ক হবে।

প্রথম আলো: গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য ভারতের ভিসা অনেক সহজ করা হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে সর্বোচ্চসংখ্যক লোক প্রতিবছর ভারত সফর করছে। বাংলাদেশের নাগরিকদের যাওয়াটা আরও সহজ করতে ভারত নতুন কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ভাবছে কি না?

রীভা গাঙ্গুলি দাশ: দুই দেশের জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বাড়াতে ভারত সরকার অব্যাহতভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে বাংলাদেশের জনগণের জন্য ভারতের ভিসা–প্রক্রিয়া ধাপে ধাপে সহজ করা হয়েছে। ২০১৪ সাল থেকে আমরা পূর্বনির্ধারিত সাক্ষাৎকারের পরিবর্তে বাংলাদেশের ভিসা আবেদনকারীদের সশরীর হাজির হয়ে ভিসার আবেদন জমা দেওয়ার ব্যবস্থা চালু করেছি। এতে সপ্তাহের যেকোনো দিনে বাংলাদেশের যেকোনো ভারতীয় ভিসা আবেদন কেন্দ্রে এসে আবেদনকারী সরাসরি তাঁর ভিসার আবেদন জমা দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। এসব পদক্ষেপের ফলে ২০১৪ সালে যেখানে সাড়ে ছয় লাখ বাংলাদেশিকে ভিসা দেওয়া হয়েছিল, ২০১৭ আর ২০১৮ সালে যথাক্রমে ১৩ লাখ ৮০ ও ১৪ লাখ ৪৭ হাজার বাংলাদেশিকে ভিসা দেওয়া হয়েছে। ২০১৯ সালে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন এবং চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা ও সিলেটের সহকারী হাইকমিশন থেকে ১৬ লাখ ১৯ হাজার ভিসা দেওয়া হয়েছে। এটাই বিশ্বের যেকোনো দেশের ভারতীয় মিশন থেকে ইস্যু করা সর্বোচ্চসংখ্যক ভিসা। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসকারীদের জন্য ভারতীয় ভিসা সহজতর করতে ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশে নতুন ছয়টি ভারতীয় ভিসা আবেদন কেন্দ্রে খোলা হয়েছে। জন্মস্থান যেখানেই হোক না কেন, এখন বাংলাদেশের এই ১৫টি ভারতীয় ভিসা আবেদন কেন্দ্রে এসে লোকজন ভিসার আবেদন করার সুযোগ পাচ্ছেন।

দুই দেশের জনগণের মাঝে যোগাযোগ বাড়ানো আর বাংলাদেশের লোকজনের জন্য ভারতে যাওয়া সহজ করতে সব স্থলবন্দর দিয়ে চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা ধাপে ধাপে উঠিয়ে নেওয়া হচ্ছে। আখাউড়া-আগরতলা আর ঘোজাডাঙা-ভোমরা স্থলবন্দরের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে প্রক্রিয়াটি চালু হয়েছে।

আপনারা জানেন, ভারতের কিছু স্থানে বিদেশিদের ভ্রমণের ওপর অতীতে যে নিষেধাজ্ঞা ছিল, তা তুলে নেওয়া হয়েছে। আমরা আনন্দের সঙ্গে দেখছি, আমাদের বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি বন্ধু এখন নিয়মিতভাবে সিকিম যাচ্ছেন। এর পাশাপাশি ঈদ এবং অন্য বড় উৎসবগুলোর সময় নির্বিঘ্নে পাসপোর্ট বিলির স্বার্থে আমরা অফিস সময়ের পরও ভিসা আবেদন কেন্দ্র খোলা রাখছি। উপরন্তু চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টিকে মাথায় রেখে জরুরি ভিত্তিতে আমরা রোগী এবং তার সঙ্গীদের ভিসা দ্রুত দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি।

প্রথম আলো: ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের পর থেকেই বাংলাদেশকে মানবিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে ভারত। এ নিয়ে বাংলাদেশের জনগণের একাংশের হতাশা রয়েছে। প্রায় তিন বছরের মাথায় এটা স্পষ্ট যে রোহিঙ্গা সংকটের মতো জটিল সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের কোনো বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে ভারতের পরিকল্পনা কী?

রীভা গাঙ্গুলি দাশ: বাংলাদেশ ও মিয়ানমার দুই দেশের প্রতিবেশী হিসেবে এই সংকটে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিটা ভারতের। মিয়ানমারের রাখাইনের মানবিক সংকট আর বাংলাদেশের ওপর এর প্রভাব সম্পর্কে আমাদের অবস্থান নিয়ে কখনো কখনো জল্পনা রয়েছে। মানবিক মূল্যবোধে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশ যেভাবে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে, ভারত সব সময় এর ভূয়সী প্রশংসা করে। এটি বাংলাদেশের ওপর বিরাট বোঝা হিসেবে চেপে বসেছে, তা আমরা স্বীকার করি। এ জন্য বাংলাদেশের প্রতি আমরা সহমর্মীও বটে। বাংলাদেশের বন্ধু ও প্রতিবেশী হিসেবে রাখাইনে মর্যাদাসম্পন্ন জীবনযাপনের লোকজনের দ্রুত ফিরে যাওয়া নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি সমাধানের বিষয়ে পূর্ণ সমর্থনের ব্যাপারে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ। তবে এটি নিরাপদে, টেকসই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হতে হবে। আমাদের প্রচেষ্টা জোরদারের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমে আমরা কক্সবাজারের শিবিরে পাঁচবার ত্রাণ দিয়েছি, ভবিষ্যতে আমাদের আরও ত্রাণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি রয়েছে। দ্রুত লোকজনকে রাখাইনে ফিরে যেতে উদ্বুদ্ধ করতে আমরা সেখানে গৃহায়ণ, বিদ্যুৎ ও শিক্ষাসহ বিভিন্ন আর্থসামাজিক উন্নয়ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছি। মিয়ানমারে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত লোকজনের শিবিরগুলো বন্ধ করে দেওয়া যে গুরুত্বপূর্ণ, সে বিষয়টি মিয়ানমারের সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ের আলোচনায় অব্যাহতভাবে তুলছি। এর পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে রাখাইনের লোকজনকে তাদের আবাসে ফিরিয়ে আনার জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরিতে উদ্বুদ্ধ করার জন্য আর্থসামাজিক প্রকল্পে অর্থায়নের ব্যবস্থা করছি। একটু ঘুরিয়ে বললে, বিরাট এই মানবিক সংকটের সমাধানের ক্ষেত্রে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো মতপার্থক্য নেই। ন্যায়সংগত ও মর্যাদাপূর্ণ মানবিক সমাধানের বিষয়টিকে বিবেচনায় নিয়ে এই সংকটের একটি বাস্তবসম্মত সমাধান হতে হবে। আর এটাই এখন সময়ের দাবি।

আমাদের দুই দেশের সীমান্ত সাধারণত শান্তিপূর্ণ থাকলেও সীমান্তের দুই পাশেই অপরাধীরা সক্রিয় রয়েছে। আমাদের দুই পক্ষের সমন্বিত সীমান্ত ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনার কার্যকারিতা, কাঁটাতারের বেড়া এবং বিএসএফ আর বিজিবির জোরালো সহযোগিতার কারণে সীমান্তের দুই পারের অপরাধীরা ইদানীং মরিয়া হয়ে উঠেছে।

প্রথম আলো: ২০১৯-এর ৫ আগস্ট সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলোপের মধ্য দিয়ে জম্মু ও কাশ্মীর এখন কেন্দ্রের শাসনের আওতায় এসেছে। ফলে সেখানকার জনগণের জীবনে কী পরিবর্তন এসেছে?

রীভা গাঙ্গুলি দাশ: গত এক বছরের সময়কালে কাশ্মীরে আর্থসামাজিক উন্নয়ন হয়েছে, যা ভারতের অন্যান্য অংশের মতোই। এই প্রথমবারের মতো সেখানে বাধ্যতামূলক শিক্ষা আইন ২০০৯, পারিবারিক সহিংসতা থেকে নারীদের সুরক্ষা আইন ২০০৫, মানবাধিকার সুরক্ষা আইন ১৯৯৪, তথ্য অধিকার আইন ২০০৫ চালু হয়েছে। গত এক বছরে জম্মু ও কাশ্মীরে ২৫ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য ৫০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, নতুন দুটি অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সেস, সাতটি নতুন মেডিকেল কলেজ, পাঁচটি নার্সিং কলেজ এবং একটি ক্যানসার ইনস্টিটিউট চালু হয়েছে। গত সাত দশকের মধ্যে এবারই প্রথম তিন লাখের বেশি পরিবার বিদ্যুতের সেবা পেতে শুরু করেছে। ওই অঞ্চলের লোকজনের জন্য সরকারি চাকরিতে আসন সংরক্ষণ করা হয়েছে। এসব উন্নয়ন প্রকল্পের সবচেয়ে বেশি সুফল পেয়েছেন নারী ও যুবসমাজ, এগুলো ছিল সেখানকার জনগণের দীর্ঘদিনের চাওয়া।

নিজেদের উন্নয়নের চাহিদা আর অগ্রাধিকারের বিষয়গুলো তুলে ধরতে লোকজন স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। দুই স্তর স্থানীয় সরকারের ব্লক উন্নয়ন কাউন্সিলের প্রথম নির্বাচন ২০১৯ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত হয়েছে। যেখানে ভোটারের অংশগ্রহণ ছিল ৯৮ শতাংশ। প্রথমবারের মতো নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করে তাদের রাজনীতিতে আসার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে, যা চূড়ান্তভাবে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করবে।

প্রথম আলো: প্রায় দেড় দশকের বিরতিতে দ্বিতীয়বারের মতো দায়িত্ব পালন করতে এলেন। এবার বাংলাদেশে কাজ করতে এসে কী পরিবর্তন আপনার চোখে পড়েছে? এই পরিবর্তনকে কীভাবে দেখছেন?

রীভা গাঙ্গুলি দাশ: প্রায় ১৭ বছরের বিরতিতে দ্বিতীয়বারের মতো ঢাকায় কাজ করতে এসে আমি মুগ্ধ। কারণ ঢাকা শহরের অর্ধেকটা আমি চিনতেই পারিনি। আগেরবার ধানমন্ডির যে জায়গাটাতে আমি থাকতাম, সেটাই চিনতেই কষ্ট হচ্ছিল। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতির ছবিটা এসব পরিবর্তনে খুব স্পষ্ট। এবার ঢাকার বাইরে গিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছোট মেয়েদের ফুটবল খেলতে দেখে অবাকই হয়েছি। ছোট ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে স্কুলে যাচ্ছে। বাংলাদেশ যে সামাজিক সূচকে অনেক এগিয়েছে, এগুলো তার প্রমাণ। এবার ঢাকায় আসার পর থেকে এমন কোনো বৈঠকে অংশ নেননি, যেখানে অন্তত একাধিক নারীর উপস্থিতি ছিল না। প্রশাসন, সেনাবাহিনী, পুলিশ এ দেশের নানা পেশায় নারীর এই উপস্থিতি তাঁদের ক্ষমতায়নের প্রমাণ দেয়। নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সামাজিক নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় প্রতিবেশী হিসেবে আমরা যথেষ্ট গর্ব করি। নতুন অনেক জায়গা রয়েছে, যেখানে আমরা একে অন্যকে সহায়তা করতে পারি।

প্রথম আলো: বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনার প্রত্যাশা কী?

রীভা গাঙ্গুলি দাশ: আমি তো মনে করি, ভবিষ্যতে আমাদের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হবে। জোরালো হবে। আমরা তাকিয়ে আছি ২০২১–এর দিকে। যখন বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপন করবে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, আগামী বছর অন্যান্য এই সম্পর্ককে তুলে ধরার ক্ষেত্রে এটা আমাদের জন্য একটি সুযোগ। আমি তো মনে করি না পৃথিবীতে আর দুইটা দেশ আছে যাদের এমন সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের পাঁচ দশক উদযাপন করার পরপরই আমরা দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর উদযাপন করব।

প্রথম আলো: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

রীভা গাঙ্গুলি দাশ: আপনাকেও ধন্যবাদ।






মতামত দিন।

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*