প্রাণের ৭১

প্রথমবারের মত ইনিংস ব্যবধানে জিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হোয়াইটওয়াশ করলো বাংলাদেশ

অবশেষে নিজেদের টেস্ট ইতিহাসে প্রথমবারের মত ইনিংস ব্যবধানে জয়ের স্বাদ নিলো বাংলাদেশ। ঢাকা টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ইনিংস ও ১৮৪ রানের ব্যবধানে হারালো সাকিবের দল। এই জয়ে দুই ম্যাচের সিরিজ ২-০ ব্যবধানে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হোয়াইটওয়াশের লজ্জা দিলো বাংলাদেশ। তবে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে দ্বিতীয়বারের মত হোয়াইটওয়াশের লজ্জা দিলো টাইগাররা। এর আগে ২০০৯ সালে সফরকারী হিসেবে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে দুই ম্যাচের সিরিজে হোয়াইটওয়াশ করেছিলো বাংলাদেশ। সব মিলিয়ে অন্তত দুই ম্যাচের সিরিজে তৃতীয়বারের মত পকোন প্রতিপক্ষ হোয়াইটওয়াশ করলো বাংলার টাইগাররা।
এ্যাচ জিততে ঢাকা টেস্টের দ্বিতীয় দিন শেষে ফলো-অনের মুখে পড়েছে সফরকারী ওয়েস্ট ইন্ডিজ। মাহমুদুল্লাহর সেঞ্চুরিতে প্রথম ইনিংসে সবকটি উইকেট হারিয়ে ৫০৮ রান করে স্বাগতিক বাংলাদেশ। জবাবে দ্বিতীয় দিনে ৭৫ রানের মধ্যেই ৫ উইকেট হারিয়েছে ফলো অনের দারপ্রান্তে পৌঁছে যায় ক্যারিবীয়রা। ৫ উইকেট হাতে নিয়ে ৪৩৩ রানে পিছিয়ে থেকে ফলো-অন এড়াতে আরও ২৩৩ রান প্রয়োজন পড়ে ক্যারিবীয়দের।
৫০৮ রানের পাহার সমান রানের চাপ মাথায় নিয়ে দ্বিতীয় দিনের শেষ বিকেলে খেলতে নামে নিজেদের প্রথম ইনিংস শুরু করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ১২ ওভার ব্যাট করে ৫ উইকেট হারিয়ে ৭৫ রান করে তারা। ২৯ রানে ৫ উইকেট হারানোর পর দলের হাল ধরেন শিমরোন হেটমায়ার ও শেন ডাউরিচ। পাঁচ ব্যাটসম্যানকে হারানোর পর আর কোন বিপদ ঘটেনি ক্যারিবীয় শিবিরে। হেটমায়ার ৩২ ও ডাউরিচ ১৭ রানে অপরাজিত ছিলেন।
তৃতীয় দিন সকালে দ্রুতই প্যাভিলিয়নে ফিরে যান হেটমায়ার। ব্যক্তিগত ৩৯ রানে বাংলাদেশের অফ-স্পিনার মেহেদি হাসান মিরাজের শিকার হন হেটমায়ার। টেল-এন্ডারদের নিয়ে দলের স্কোর শতরানে পৌঁছে দেন ডাউরিচ। তবে দলীয় ১১০ রানে ফিরেন তিনি। মিরাজের শিকার হবার আগে ৩৭ রান করেন তিনি। তার বিদায়ের পরই ১১১ রানে শেষ হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইনিংস। বাংলাদেশের বিপক্ষে টেস্টে এটিই সর্বনি¤œ রান ক্যারিবীয়দের। বাংলাদেশের পক্ষে ৫৮ রানে ৭ উইকেট নেন মিরাজ। ইনিংসে এটি তার ক্যারিয়ারের সেরা বোলিং। এছাড়া সাকিব ২৭ রানে ৩ উইকেট নেন।
১১১ রানে অলআউট হয়ে ফলো-অনে পড়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। নিজেদের ক্রিকেট ইতিহাসে এই প্রথমবারের মত প্রতিপক্ষকে ফলো-অনে বাধ্য করে টাইগাররা। ফলো-অনে পড়ে ম্যাচের তৃতীয় ইনিংসে ব্যাট হাতে নেমে আবারো বাংলাদেশ বোলারদের ঘুর্ণিতে পড়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের টপ-অর্ডার। এবার ২৯ রানে ৪ উইকেট হারায় তারা। প্রথম ইনিংসে ২৯ রানে ৫ উইকেট হারিয়েছিলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের অধিনায়ক ক্রেইগ ব্রাফেট এবারও সাকিবের শিকার হন। প্রথম ইনিংসে সাকিবের শিকার হয়ে শূন্য হাতে ফিরেছিলেন তিনি। এবার ১ রান করে বিদায় নেন ব্রাফেট।
আরেক ওপেনার কাইরেন পাওয়েল ৬ রান করে এই ইনিংসে মিরাজের প্রথম শিকার হন। প্রথম ইনিংসে মিরাজ-সাকিব মিলে ধসিয়ে দিয়েছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইনিংস। তাই অন্য তিন বোলার তাইজুল-নাইম-মাহমুদুল্লাহকে থাকতে হয় উইকেট শুন্য। কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংসের ১১তম ওভারে প্রথম উইকেট শিকারের স্বাদ নেন বাংলাদেশের তাইজুল। চার নম্বরে নামা সুনীল অ্যামব্রিসকে ৪ রানে থামিয়ে দেন তাইজুল। তবে এখানেই নিজেকে গুটিয়ে নেননি তাইজুল। নিজের পরের ওভারেই ৩ রান করা রোস্টন চেজকে বিদায় দেন তাইজুল।
এপরপর প্রতিরোধ গড়ে তুলেন হেটমায়ার ও শাই হোপ। বাংলাদেশী বোলারদের সামনে ব্যাট হাতে লড়াই করার চেষ্টা করেন তারা। ফলে দলীয় স্কোর ৫০ থেকে ১শ’র দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। এমনবস্থায় বাংলাদেশকে ব্রেক-থ্রু এনে দেন প্রথম ইনিংসে ৭ উইকেট নেয়া মিরাজ। ২৫ রান করা হোপকে থামান মিরাজ।
দলীয় স্কোর তিন অংকে পৌঁছানোর আগে আরও একটি উইকেট হারায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এবার উইকেট শিকারের তালিকায় নাম তুলেন নাইম হাসান। ৩ রান করা ডাউরিচকে বিদায় দেন নাইম।
৯৬ রানে ৬ উইকেট হারানোয় প্রথম ইনিংসের মত দ্রুত গুটিয়ে যাবার শংকায় পড়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্কোরকে বড় করতে থাকেন হেটমায়ার। এক প্রান্ত আগলে আগাসী মেজাজে বাট চালান ৯টি ছক্কা ও একটি চার মেরে দলের পরাজয়ের ব্যবধান কমিয়েছেন তিনি। । সাকিবকে এক ওভারে তিনটিসহ মোট ৪টি, তাইজুলকে ৩টি ও মিরাজকে ২টি ছক্কা মারেন হেটমায়ার। হেটমায়ারের একমাত্র বাউন্ডারিটি আসে নাইম হাসানের ডেলিভারি থেকে।
মিরাজকে ছক্কা মেরে ৪৬তম ওভার শুরু করেছিলেন হেটমায়ার। কিন্তু দ্বিতীয় বলে আবারো ছক্কা মারতে গিয়ে বিদায় নেন তিনি। ফলে সেঞ্চুরির আশা জাগিয়েও ৯৩ রানে থামেন হেটমায়ার। ইনিংসে ৯২ বল খেলেন তিনি।
দলীয় ১৬৬ রানে অষ্টম ব্যাটসম্যান হিসেবে হেটমায়ারের বিদায়ের পরপরই জোমেল ওয়ারিকানকে শিকার করে এই ইনিংসেও নিজের পাঁচ উইকেট পূর্ণ করেন মিরাজ। এমন অবস্থায় জয় থেকে ১ উইকেট দূরে দাড়িয়ে ছিলো বাংলাদেশ। কিন্তু শেষ উইকেটে জুটি বেধে বাংলাদেশের জয়কে দীর্ঘায়িত করেন কেমার রোচ ও শিরমোন লুইস। দশম উইকেটে অবিচ্ছিন্ন ৪২ রান যোগ করে ওয়েস্ট ইন্ডিজের হারের ব্যবধান কমান রোচ ও লুইস।
লুইসকে এলবিডব্লুর ফাঁদে ফেলে ওয়েস্ট ইন্ডিজের শেষ উইকেট তুলে নিয়ে বাংলাদেশকে অবিস্মরণীয় জয়ের স্বাদ পাইয়ে দেন তাইজুল। ২১৩ রানে অলআউট হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। লুইস ২০ রানে থামলেও ৩৭ রানে অপরাজিত থেকে যান রোচ। এই ইনিংসে ৫৯ রানে ৫ উইকেট নেন মিরাজ। ফলে ম্যাচে তার উইকেট শিকার দাড়ালো ১১৭ রানে ১২ উইকেট। যা তার ক্যারিয়ারের সেরা ম্যাচ বোলিং ফিগার। এছাড়া তাইজুল ৩টি, সাকিব-নাইম ১টি করে উইকেট নেন। ম্যাচ সেরা হয়েছেন মিরাজ ও সিরিজ সেরা হন সাকিব।
দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজ শেষে এবার তিন ম্যাচের ওয়ানডে খেলবে বাংলাদেশ ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ। যা শুরু হবে ৯ ডিসেম্বর।
স্কোর কার্ড :
বাংলাদেশ প্রথম ইনিংস : ৫০৮/১০, ১৫৪ ওভার (মাহমুদুল্লাহ ১৩৬, সাকিব ৮০, ব্রাফেট ২/৫৭) :
ওয়েস্ট ইন্ডিজ প্রথম ইনিংস (আগের দিন ৭৫/৫, ২৪ ওভার, হেটমায়ার ৩২*, ডওরিচ ১৭*, মিরাজ ৩/৩৬) :
ক্রেইগ ব্রাফেট বোল্ড ব সাকিব ০
কাইরেন পাওয়েল বোল্ড মিরাজ ৪
শাই হোপ বোল্ড ব মিরাজ ১০
সুনীল অ্যামব্রিস বোল্ড ব সাকিব ৭
রোস্টন চেজ বোল্ড ব মিরাজ ০
শিমরোন হেটমায়ার ক এন্ড ব মিরাজ ৩৯
শেন ডাউরিচ এলবিডব্লু ব মিরাজ ৩৭
দেবেন্দ্র বিশু ক সাদমান ব মিরাজ ১
কেমার রোচ ক লিটন ব মিরাজ ১
জোমেল ওয়ারিকান অপরাজিত ৫
শিরমোন লুইস এলবিডব্লু ব সাকিব ০
অতিরিক্ত (বা-৪, লে বা-৩) ৭
মোট (অলআউট, ৩৬.৪ ওভার) ১১১
উইকেট পতন : ১/০ (ব্রাফেট), ২/৬ (পাওয়েল), ৩/১৭ (অ্যামব্রিস), ৪/২০ (চেজ), ৫/২৯ (হোপ), ৬/৮৬ (হেটমায়ার), ৭/৮৮ (বিশু), ৮/৯২ (রোচ), ৯/১১০ (ডাউরিচ), ১০/১১১ (লুইস)।
বাংলাদেশ বোলিং :
সাকিব আল হাসান : ১৫.৪-৪-২৭-৩,
মেহেদি হাসান মিরাজ : ১৬-১-৫৮-৭,
নাইম হাসান : ৩-০-৯-০,
তাইজুল ইসলাম : ১-০-১০-০,
মাহমুদুল্লাহ : ১-১-০-০।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ দ্বিতীয় ইনিংস (ফলো-অন) :
ক্রেইগ ব্রাফেট এলবিডব্লু ব সাকিব ১
কাইরেন পাওয়েল স্ট্যাম্প মুশফিক ব মিরাজ ৬
শাই হোপ ক সাকিব ব মিরাজ ২৫
সুনীল অ্যামব্রিস এলবিডব্লু ব তাইজুল ৪
রোস্টন চেজ ক মোমিনুল ব তাইজুল ৩
শিমরোন হেটমায়ার ক মিথুন ব মিরাজ ৯৩
শেন ডাউরিচ ক সৌম্য ব নাইম ৩
দেবেন্দ্র বিশু ক সৌম্য ব মিরাজ ১২
কেমার রোচ অপরাজিত ৩৭
জোমেল ওয়ারিকান ক এন্ড ব মিরাজ ০
শিরমোন লুইস এলবিডব্লু ব তাইজুল ২০
অতিরিক্ত (বা-৬, লে বা-৩) ৯
মোট (অলআউট, ৫৯.২ ওভার) ২১৩
উইকেট পতন : ১/২ (ব্রাফেট), ২/১৪ (পাওয়েল), ৩/২৩ (অ্যামব্রিস), ৪/২৯ (চেজ), ৫/৮৫ (হোপ), ৬/৯৬ (ডওরিচ), ৭/১৪৩ (বিশু), ৮/১৬৬ (হেটমায়ার), ৯/১৭১ (ওয়ারিকান), ১০/২১৩ (লুইস)।
বাংলাদেশ বোলিং :
সাকিব আল হাসান : ১৪-৩-৬৫-১,
মেহেদি হাসান মিরাজ : ২০-২-৫৯-৫,
তাইজুল ইসলাম : ১০.২-১-৪০-৩,
মাহমুদুল্লাহ : ১-০-৬-০।
নাইম হাসান : ১৪-২-৩৪-১।
ফল : বাংলাদেশ ইনিংস ও ১৮৪ রানে জয়ী।
সিরিজ : দুই ম্যাচের সিরিজ ২-০ ব্যবধানে জিতে নিলো বাংলাদেশ।
ম্যাচ সেরা : মেহেদি হাসান মিরাজ (বাংলাদেশ)।
সিরিজ সেরা : সাকিব আল হাসান (বাংলাদেশ)।






মতামত দিন।

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*