প্রাণের ৭১

বাচ্চার বয়ঃসন্ধিকালে আপনার দায়িত্ব – অপরাজিতা নীল

আমার যখন প্রথম পিরিয়ড হয়, তখন বয়স ১২ বছর ৩ মাস। রোজার মাস। সবাই সেহেরী খাচ্ছি। তরকারী দিয়ে ভাত খাওয়া শেষ করে, দুই নলা হলেও দুধ দিয়ে ভাত খেতে হত, নইলে রোজা থাকতে দিত না। তো দুধ ভাত নিতে গেছে, আর আমার খালা খপ করে আমার হাত ধরে বেসিনের সামনে নিয়ে এসে বলল, হাত ধো। এরপর টেনে রুমে নিয়ে আসল। নিয়ে এসে বলে ‘প্যান্ট খোল’। কি অপমান! আমি তো গাই গুই করি। খালা কলের গানের মত একই কথা বলে যাচ্ছে – ‘প্যান্ট খোল’, ‘প্যান্ট খোল’। আমি চিল্লাচিল্লি শুরু করলাম এক পর্যায়ে। খালা আম্মাকে ডেকে নিয়ে আসলো। কানে কানে যেন কি বলল। মুহুর্তেই আম্মার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। আম্মার এরপর মাথায় হাট-টাত বুলিয়ে দিয়ে বলা অনুরোধ করল। আমি প্যান্টি খুলতেই আম্মা কান্নাকাটি শুরু করল। নিচে তাকিয়ে আমি আঁতকে উঠলাম। শুরু করলাম চিৎকার। বাসায় তখন হুলুস্থল অবস্থা। আমার মায়র রাবনের সংসার ছিল সারাজীবনই। ১৮/২০ জন সেহেরী খাচ্ছিল। সবাই জেনে গেলো। যারা জানলো না, তারা পরের কয়েকদিনের বুঝে গেলো যখন আমাকে সবাই মিলে আমার বেডরুমে আটকে রাখল, তখন। এখানেই কিচ্ছা শেষ না। নানী-দাদী-খালা-মামী-ফুপুরা এসে পিঠা টিঠা বানিয়ে পুরা উৎসব বানিয়ে ফেলল। পিরিয়ড হওয়ার উৎসব! আমি লজ্জায় মরে গেলাম!!!
.
নাহ, আমি নারীবাদী নই, পিরিয়ড নিয়ে কথা বলছি বলে যে রক্তমাখা প্যাডের ছবি তুলে দুনিয়ার মানুষকে দেখিয়ে বেড়াব, সেটার পক্ষে আমি নই। সেটা দেখিয়ে বেড়ানোতে কি হাসিল হয়, সেটাও আমার জানা নেই। তবে, আমি বাস্তববাদী। আমার মনে হয়, পিরিয়ড ব্যাপারটি নিয়ে জনসচেতনতা তৈরির দরকার আছে। এবং এই ব্যাপারটার সাথে বাচ্চাদের আগে থেকেই পরিচয় করিয়ে দেয়া আমাদের কর্তব্য। এই কথাগুলো বলছি যাদের মেয়েবাচ্চা আছে, সেইসব বাবা-মা কে। আপনাদের বাচ্চাদের পিরিয়ড হয়ে গেলে হয়ত আপনার কোনো না কোনোভাবে ম্যানেজ করে ফেলেছেন। কিন্তু যাদের বাচ্চাদের এখনো পিরিয়ড হয়নি, দয়া করে কিছু জিনিশ মাথায় রাখুন।
.
১) যে কোনো কারনেই হোক, আমার ধারণা বাচ্চাদের পিরিয়ড হওয়ার বয়স ১/২ বছর এগিয়ে এসেছে। আমাদের কালে স্বাস্থ ভালো হোক বা মন্দ, এমন ১২/১৩ বছরেই হত। কিন্তু এখন ১০/১১ তেই বাচ্চাদের পিরিয়ড শুরু হয়ে যাচ্ছে। এটা নিয়ে নিজেরা মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকুন।
.
২) বাচ্চাকে পিরিয়ড সম্পর্কে বিস্তারিত জানান। কেন হয়, হলে কি হয়, ক্যামন করে ম্যানেজ করতে হয়, সাইড ইফেক্ট কি হয়, কোন কোন ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হয় ইত্যাদি বিস্তারিতভাবে বলুন। এই লেসন ৯ বছর বয়স থেকেই হালকা পাতলাভাবে দিন। ২/৩ মাস পর পর ডেমো দিন। রিভিশন দিন বাচ্চাকে নিয়ে নিজেরা। একটাসময় সে পুরো ব্যাপারটায় অভ্যস্ত হয়ে যাবে।
.
৩) পিরিয়ড হলে বাচ্চাদের মনোজগতে চেঞ্জ আসতে শুরু করে। হঠাত করে তাদের মনে হয়, যেটা হয়েছে, এটা একটা খারাপ কাজ। তার নিজের কোনো অন্যায়ের জন্য এটা নিশ্চই তার হয়েছে। কিংবা হলেও এত আগে আগে হওয়ার জন্য সে হয়ত কোনোভাবে দায়ী।

একারণে দয়া করে বাচ্চাকে এব্যাপারটা নিয়ে যখন লেসন দেবেন, সেটাকে সাইন্টিফিকওয়েতে দেয়ার চেষ্টা করুণ। তাঁকে বোঝাবেন, এটা একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তোমার দাঁত পড়ে গিয়ে নতুন দাঁত গজানো যেমন একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, এটাও তেমন। তোমার ক্ষুধা লাগে একটা নির্দিষ্ট সময় পর পর, তুমি পটি-পিপি করো একটা ইন্টারভ্যালের পর পর, তেমনি পিরিয়ডও একটা সার্টেন এজের পর শুরু হবে এটাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তোমার যেমন হয়েছে, তেমনি তোমার মায়ের, নানুর, খালার, দাদুরঅও হয়েছে। তোমার বাচ্চারও হবে।
.
৪) আমার মতে, এখন তুমি বড় হয়ে গেছো, এখন ছেলেদের সাথে মিশবানা, এখন বড় কাপড় পড়তে হবে, এখন বাসার ছেলেদের, বাবা, ভাইয়ের থেকেও দূরে থাকতে হবে। এই জাতিয় কথা পিরিয়ডের সাথে মিলিয়ে না বলাই ভালো। সেটা বাচ্চার মনজগতে বাজে প্রভাব ফেলে। খুব বাজেভাবে তখন তারা বাবা বা ভাইয়ের সাথে একটা দূরত্ব তৈরী করে ফেলে এবং তাদেরকে পর ভাবতে শুরু করে।

তাঁকে এধরনের সচেতনতার শিক্ষা দিন। তবে এর সাথে মিলিয়ে নয়।
.
৫) পিরিয়ড চলাকালীন সময়ে বাচ্চাদেরকে পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার দিন। তাদের পেটে ব্যাথা হতে পারে, কোমরে ব্যাথা হতে পারে, মাথাব্যাথাও হতে পারে – এসব দিকে লক্ষ রাখুন। তাকেও জানিয়ে রাখুন। বাচ্চাকে পর্যাপ্ত ঘুমাতে দিন।
.
৬) প্রথম প্রথম ১/২ দিন বাচ্চার সাথে মায়েরা বাথরুমে যান। তাকে ভালো কয়ে বুঝিয়ে দিন কিভাবে প্যাড পড়তে হয়, চেঞ্জ করতে হয়ে এবং প্রপারলি র‍্যাপ করে একটা আলাদা ব্যাগে ভরে ডিসপোজ করতে হয়। তাঁকে তার আন্ডারওয়ার নিজে নিজে কিভাবে ক্লীন করতে হয়, সেটা হাতে ধরে শেখান। নিজেকে কিভাবে ক্লীন রাখতে হবে সেটা শেখান।
.
৭) আরো হয়ত থাকতে পারে, কিন্তু আমার আপাতত এইগুলোই মনে পড়ল। এখন শেষ এবং সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ন পার্টটা বলছি –

আমাদের অনেকের মাঝেই একটা পুরোনো ধারনা জেঁকে বসে আছে। আর সেটি হচ্ছে – পিরিয়ড হয়ে গেছে মানে বাচ্চা বড় হয়ে গেছে। আমরা কি এক বিচিত্র কারনে এই ১১/১২/১৩ বছরের বাচ্চাগুলোকে শুধুমাত্র পিরিয়ড হয়েছে বলে বড় মানুষ হিসেবে ধরে নেই। এবং তাদের সাথে আচরনও করি সেভাবে।

কিন্তু একবার চিন্তা করে দেখুন তো, আদতে তারা কতটা বড় হয়ে যায় এই একটিমাত্র কারণে? একমাস আগে যে শিশু আপনার কাছে শিশু ছিল, সে কি এই একমাসের ব্যাবধানে শিশু থেকে বড় হয়ে গেল কেবলমাত্র এই একটি কারণেই।

ছবিঃ ইব্রাহিম খান মনি


আপনাদের কাছে মিনতি করি, দয়া করে এ কাজটি করবেন না। বাচ্চাকে সময় নয়ে বড় হওয়ার সুযোগ দিন। তাকে দূরে ঠেলে দিয়ে বড় হতে দেবেন না প্লিজ। এ বাচ্চা তখনো বাচ্চাই থাকে। তার শিশুকাল এক্সটেন্ডেড হোক। তার মন ফড়িং এর মত থাকুক না আরো কিছুকাল। একটা সময় তো আমরা সকলেই বড় হয়েই যাই। বড় থেকে বুড়ো হয়ে মরে যাই। শিশুকালে কি আর চাইলেই পারি ফিরে যেতে? থাকুকনা মেয়েগুলো মায়ের বুকে, বাবার বুকে আরো কিছুকাল লেপ্টে।

লিখেছেনঃ অপরাজিতা নীল,এক্টিভিস্ট






মতামত দিন।

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*