প্রাণের ৭১

মেয়ের ধর্ষণকারীকে কুপিয়ে হত্যা করলেন এক মা

দক্ষিণ আফ্রিকায় এক নারী তার মেয়ের তিন ধর্ষণকারীর একজনকে হত্যা এবং বাকি দু’জনকে মেরে আহত করেছেন। নকুবঙ্গা কাম্পি নামের ওই নারী এ ঘটনার জন্য পরিচিত হয়ে উঠেছেন ‘সিংহ মা’ হিসেবে। এই ঘটনার পর তার বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ আনা হয়েছিল কিন্তু জনগণের প্রতিবাদের কারণে তার বিচার বন্ধ করে দিতে হয়েছে। খবর বিবিসির।

ঘটনার বিস্তারিত সম্পর্কে জানা যায়, ঘটানার রাতে নকুবঙ্গা কাম্পি ঘুমাচ্ছিলেন। তখন মধ্যরাত। সে সময়ই ফোনের ওপাশে তার মেয়ে সিফোকাজি জানান তিনজন পুরুষ তাকে ধর্ষণ করেছে এবং তাদের সবাইকে তিনি চেনেন। তার মেয়ে ৫শ মিটার দূরে ছিল।

এ খবর শুনে নকুবঙ্গা প্রথমেই তার মেয়েকে পুলিশের সাথে যোগাযোগ করতে বললেন। কিন্তু ওপাশ থেকে তিনি কোন সাড়া পেলেন না।

মা নকুবঙ্গা জানতেন পুলিশের সাথে যোগাযোগ করা হলেও দক্ষিণ আফ্রিকার ইস্টার্ন কেইপ প্রদেশের প্রত্যন্ত এই গ্রামটিতে পৌঁছাতে তাদের অনেক সময় লাগবে।

সিফোকাজি ভেবেছিলেন এরকম একটা সময়ে সাহায্যের জন্যে হয়তো তার মাই একমাত্র আছেন, যিনি এগিয়ে যেতে পারেন।

নকুবঙ্গা বলেন, আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম। কিন্তু আমি যেতে বাধ্য হলাম কারণ সে তো আমারই মেয়ে। আমি ভাবছিলাম যখন আমি পৌঁছাব তখন হয়তো দেখব সে মরে পড়ে আছে। কারণ সে তো ধর্ষণকারীদের চিনতো।

ওই লোকগুলো যেহেতু তাকে চেনে সে কারণে ওরা নিশ্চয়ই আমার মেয়েকে মেরে ফেলতো যাতে সে ধর্ষণের ব্যাপারে পুলিশের কাছে অভিযোগ করতে না পারে।

সিফোকাজি কয়েকজন বন্ধুর সাথে দেখা করতে ওই গ্রামেরই আরেকটি বাড়িতে গিয়েছিলেন। তিনি যখন ঘুমিয়ে ছিলেন তার বন্ধুরা তাকে একা রেখে বাড়ির বাইরে চলে যায়। রাত দেড়টার দিকে আশেপাশের আরেকটি বাড়ি থেকে তিনজন মাতাল পুরুষ এসে তাকে আক্রমণ করে।

নকুবঙ্গা মেয়ের বিপদের কথা শুনে ঘুম থেকে ওঠে কিচেনে গিয়ে সেখান থেকে একটি ছুরি হাতে নিলেন।

তিনি বলেন, ছুরিটা আমি নিয়েছিলাম আমার নিজের জন্য। রাতের অন্ধকারে যখন রাস্তা দিয়ে ওই বাড়িতে হেঁটে যাব, ভেবেছিলাম ওটা আমার জন্য নিরাপদ হবে না। খুব অন্ধকার ছিল বাইরে। মোবাইল থেকে টর্চের আলো জ্বালিয়ে পথ দেখে দেখে আমাকে যেতে হয়েছিল।

মা নকুবঙ্গা যখন ওই বাড়ির কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছালেন তখন তিনি মেয়ের চিৎকার শুনতে পেলেন। বাড়িটির বেডরুমে ঢোকার পর মোবাইল ফোনের টর্চের আলোতে তিনি যে ভয়াবহ দৃশ্য দেখলেন তার জন্য তিনি মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না।

তিনি বলেন, আমি খুব ভয় পেয়ে যাই। কোন রকমে দরজার পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। জিজ্ঞেস করলাম তারা ওখানে কী করছে। আমাকে দেখে তারা আমার ওপর আক্রমণ চালাতে ছুটে এলো। ঠিক ওই মুহূর্তে আমার নিজেকে বাঁচানোর কথা মনে হয়েছিল। এর বিস্তারিত কিছু জানাতে চাননি মা নকুবঙ্গা।

এই মামলার বিচারের সময় বিচারক আদালতে বলেছিলেন, নকুবঙ্গার সাক্ষ্য থেকে বোঝা যায় যে তিনি কতটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন। কারণ তিনি দেখতে পেলেন যে তার মেয়েকে তার চোখের সামনে ধর্ষণ করা হচ্ছে।

তিনি বলেছেন যে, তিনজন পুরুষের একজন তার মেয়েকে ধর্ষণ করছিল আর দু’জন পাশেই দাঁড়িয়েছিল। তারা অপেক্ষা করছিল তাদের পালা কখন আসবে।

বিচারক এম্বুলেলো জলওয়ানা বলেন, তিনি যে খুব ক্রুদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন সেটা বোঝা যায়। এটা পরিষ্কার যে ওই পুরুষরা যখন নকুবঙ্গাকে আক্রমণ করে তখন তিনিও তার ছুরি দিয়ে পাল্টা আঘাত করেছিলেন। যখন তারা পালাতে উদ্যত হয় তখন তিনি ছুরি মারেন।

তাদের একজন জানালা দিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। ধর্ষণকারীদের দু’জন গুরুতর আহত হয় এবং অন্যজন মারা যায়।

ওই লোকগুলো কতটা আহত হয়েছিল নকুবঙ্গা সেটা দেখার জন্য ওই বাড়িতে আর অবস্থান করেননি। বরং তার মেয়েকে নিয়ে চলে যান কাছেই এক বন্ধুর বাড়িতে।

পরে পুলিশ এসে নকুবঙ্গাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। তাকে নিয়ে যাওয়া হয় স্থানীয় একটি পুলিশ স্টেশনে। সেখানে একটি সেলে তাকে বন্দি করে রাখা হয়।

তিনি বলেন, আমি শুধু আমার মেয়ের কথা ভাবছিলাম। তার কোন খবর ছিল না আমার কাছে। এটা এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা।

দক্ষিণ আফ্রিকাতে প্রচুর ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। বলা হয় যে, দিনে গড়ে ১১০টির মতো ধর্ষণের ঘটনা ঘটে এবং এই পরিস্থিতিকে প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা দেশের জন্য জাতীয় সঙ্কট বলে উল্লেখ করেছেন।

ইস্টার্ন কেইপ প্রদেশ সিফোকাজিকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল। এটি দেশটির অন্যতম দরিদ্র একটি এলাকা। সেখানে বেকারত্বের হার ৪৫ শতাংশ।

অন্য যে কোন জায়গার চেয়ে এই প্রদেশে ধর্ষণের ঘটনাও ঘটে বেশি। নকুবঙ্গা এবং সিফোকাজি যে গ্রামে থাকেন, সেই গ্রামেই ২০১৭ থেকে ২০১৮ সালে ৭৪টি ধর্ষণের ঘটনা পুলিশের কাছে রিপোর্ট করা হয়েছে। যে গ্রামে মাত্র ৫ হাজারেরও কম মানুষের বসবাস- সেখানে এই সংখ্যা খুবই বেশি।

কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকায় এত সব ধর্ষণের খবরের মধ্যে সিফোকাজি ও নকুবঙ্গার ঘটনা মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ধর্ষিতা মেয়েকে বাঁচাতে মায়ের এই গল্প উঠে এসেছে সংবাদ মাধ্যমে।

নকুবঙ্গার বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ আনার সিদ্ধান্তেরও তীব্র সমালোচনা করলো দক্ষিণ আফ্রিকার লোকজন। তার আইনি লড়াইয়ে সহযোগিতা করতে তারা অর্থ সংগ্রহেও নেমে পড়ে।

তারপর থেকে ধীরে ধীরে তার প্রতি জনগণের সমর্থন বাড়তেই লাগলো। মানসিকভাবেও তিনি কিছুটা শক্তি পেতে শুরু করলেন। ঘটনার এক মাস পর তিনি উপস্থিত হলেন স্থানীয় একটি ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে।

তিনি বলেন, আদালতে যাওয়ার ব্যাপারে আমি ভয়ে ছিলাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে আমি প্রার্থনা করলাম। তিনি যখন আদালতে গিয়ে হাজির হলেন তখন তিনি দেখলেন যে, সেখানে তার প্রতি সমর্থন জানিয়ে আরো বহু শুভাকাঙ্ক্ষী ইতোমধ্যেই সেখানে জড়ো হয়েছেন।

তিনি বলেন, সারা দক্ষিণ আফ্রিকা থেকেই লোকজন এসেছিল। আমি তাদেরকে ধন্যবাদ জানাই। তারা আমাকে খুব জোরালো সমর্থন দিয়েছিল। আশাও দিয়েছে।

তখন তাকে খুব দ্রুত আদালতের সামনে হাজির করা হয় এবং বলা হয় যে, তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, আমি শুধু দাঁড়িয়ে ছিলাম। খুব খুশি হয়েছিলাম তখন। তখন বুঝলাম যে কোনটা ভুল আর কোনটা ঠিক বিচার ব্যবস্থা সেটা নির্ধারণ করতে পারে। তারা ঠিকই বুঝতে পেরেছিল যে কারো জীবন কেড়ে নেওয়া আমার লক্ষ্য ছিল না।

তার আইনজীবী বলেন, মামলা তুলে নেওয়ার পর মা তার মেয়েকে ডাকলেন। সেদিনই প্রথম আমি তার মেয়েকে হাসতে দেখলাম। সেদিন সে বলেছিল যে ধর্ষণকারীদেরকে সে জেলখানায় দেখতে চায়।

এজন্যে তাদেরকে আরো এক বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে বেঁচে থাকা দুজন ধর্ষণকারীকে ৩০ বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

সিফোকাজির বয়স এখন ২৭। ধর্ষণকারীদের বিচার ও সাজা হওয়ার কারণে তিনি খুশি। কিছুটা নিরাপদও বোধ করছেন তিনি। তবে তিনি মনে করেন ওদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হওয়া উচিত ছিল।

এর পরে মামলাটি যখন পুরোপুরি বাতিল হয়ে গেল তখন তিনি নাম প্রকাশ করতে এগিয়ে এলেন যাতে ধর্ষণের শিকার অন্যান্যরাও তার ঘটনা থেকে উৎসাহিত হয়।

তিনি বলেন, আমি বলবো যে এরকম একটা ঘটনার পরেও জীবন আছে। এর পরেও আপনি সমাজে ফিরে যেতে পারেন। পারেন খুব স্বাভাবিক জীবন চালিয়ে যেতে। মা নকুবঙ্গাও আশা করেন যে, তার মেয়ের ধর্ষণকারীরা এই ঘটনা থেকে শিক্ষণীয় কিছু একটা পাবে।

আরো পড়ুন: চীনে মুসলিমদের নির্যাতনের সঙ্গে গুঁড়িয়ে দেয়া হচ্ছে মসজিদ

তিনি বলেন, তাদের সাজা যখন শেষ হয়ে যাবে, আমি আশা করছি তারা নিজেদের বদলে নতুন মানুষ হিসেবে সমাজে ফিরে যাবে। মানুষের কাছে তারা হয়ে থাকবে জীবন্ত উদাহরণ। সূত্র: বিবিসি।



« (পূর্বের সংবাদ)



মতামত দিন।

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*