প্রাণের ৭১

যোগ্যতার চেয়ে আত্মবিশ্বাসের ওপর বেশি দৃষ্টি: মোহাম্মদ হাসান

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, অযোগ্য নেতৃত্ব, নীতিহীন নেতা ও কাপুরুষ রাজনীতিবিদদের সঙ্গে কোনোদিন একসঙ্গে হয়ে দেশের কাজে নামতে নেই। তাতে দেশসেবার চেয়ে দেশের ও জনগণের সর্বনাশই বেশি হয়। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের চারটি জিনিসের প্রয়োজন, তা হচ্ছে : নেতৃত্ব, ম্যানিফেস্টো বা আদর্শ, নিঃস্বার্থ কর্মী এবং সংগঠন। ভিক্ষুক জাতির ইজ্জত থাকে না। বিদেশ থেকে ভিক্ষা করে এনে দেশকে গড়া যাবে না। দেশের মধ্যেই পয়সা করতে হবে। বাংলার ঊর্বর মাটিতে যেমন সোনা ফলে, ঠিক তেমনি পরগাছাও জন্মায়। একইভাবে, বাংলাদেশে কতোকগুলো রাজনৈতিক পরগাছা রয়েছে, যারা বাংলার মানুষের বর্তমান দুঃখ-দুর্দশার জন্য দায়ী।

‘হোয়াই সো মেনি ইনকমপিটেন্ট মেন বিকাম লিডারস’ বইয়ের লেখক ও মনোবিদ ড: টমাস চামোরো পিরেমুজিক বলছেন, রাজনীতি বা ব্যবসায় নেতা পছন্দ করার ক্ষেত্রে আমরা বিবেচনাযোগ্য দায়িত্বশীলতার মুখোমুখি হই কিন্তু আমরা তাদের নির্বাচন করি -কিন্তু সেটা আমাদের প্রতিষ্ঠান বা দেশের জন্য ভালো না মন্দ তা যাচাই করা হয় না।

“আমরা সিদ্ধান্ত নেই কিন্তু আমাদের হাতে পর্যাপ্ত তথ্য থাকে না যা দিয়ে বুঝা যায় যে এসব নেতারা ভালো করবেন কি-না। পরিণামে তাদের নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা আছে কি-না সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে আমরা স্টাইল বা এমন বিষয়ের দিকে মনোযোগ দেই”।

তাঁর মতে, “আমরা যোগ্যতার চেয়ে আত্মবিশ্বাসের ওপর বেশি দৃষ্টি দেই এবং প্রায় সময়েই আমরা জব ইন্টারভিউ বা টেলিভিশন বিতর্কের মতো অল্প সময়ের আলাপচারিতার ওপর ভিত্তি করেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি।”

দ্বিতীয়ত: বিনয়ের চেয়ে ক্যারিশমা গুরুত্ব পায় বেশি।

তৃতীয়ত: নেতাদের আমরা স্বার্থপরের মতো এমনভাবে মানতে শুরু করি যা সবচেয়ে উদ্বেগজনক।

একই ভুল বারবার করার কারণ ও ভুল ব্যক্তিকে নির্বাচন করা।

‘সম্ভবত আমরা আসলে সেরা ব্যক্তিকেই চাকুরীতে দেখতে চাই না’ বলছেন মনোবিদ মি: টমাস।

তাঁর মতে. অনেক সময় মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগ স্বল্প মেয়াদী লক্ষ্য ঠিক করে। তাদের মন্তব্য থাকে ‘এই ব্যক্তি সমস্যার দ্রুত সমাধান করতে পারবে’।

“প্রতিটি সংগঠন বা ব্যবসায় নেতৃত্বে যারা আছেন তাদের কাজের মূল্যায়ন হওয়া উচিত এভাবে যে তারা অধীনস্থদের বা টিমকে কতটা প্রভাবিত করতে পেরেছেন”।

“যখন নেতাদের প্রসঙ্গ আসে তখন যোগ্যতার বিষয়টিকে যতটা গুরুত্ব দেয়া উচিত ততটা আমরা দেই না-এটা ব্যবসা ও রাজনীতি দুই জায়গাতেই। ”

এটি ‘হোয়াই সো মেনি ইনকমপিটেন্ট মেন বিকাম লিডারস’ বইয়ের লেখক ও মনোবিদ ড: টমাস চামোরো পিরেমুজিক এর মন্তব্য।

নারীদের জন্য নেতৃত্ব পর্যায়ের পদগুলোতে উঠে আসা কেন কঠিন তা নিয়েও মি: টমাস তাঁর বইয়ে অনেক যুক্তি-তর্ক দিয়েছেন।

তাঁর যুক্তি: সমাজে আমরা পুরুষদের দৃষ্টিকোণ থেকে যোগ্যতাকে দেখতে ভালোবাসি কারণ এর জন্য তাদেরকেই আমরা পুরস্কৃত করতে চাই।

কোম্পানি বা ডেমোক্রেসি- অযোগ্য নেতাদের সরানোর কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বাতলে দিয়েছেন লেখক ও মনোবিদ ড: টমাস চামোরো পিরেমুজিক।

১. ভোটে হোক আর হায়ার করে আনা হোক, কয়েকটি বিষয় যত্ন সহকারে বিবেচনা করতে হবে।

যেমন- যোগ্যতা, দক্ষতা, বিনয়, আত্ম সচেতনতা, সততা ও শেখার ক্ষমতা।

২. ধারণা নয় বরং তথ্য উপাত্তের ওপর নির্ভর করা।

৩. লিঙ্গ বৈচিত্র্যের ক্ষেত্রে লিঙ্গকে নয় বরং মেধাকে গুরুত্ব দেয়া।

মন্দ লোকের ক্ষমতাসীন হওয়া প্রসঙ্গে হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে আছে, তিনি বলেন, একবার হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) এক মজলিসে উপস্থিত লোকদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখছিলেন। এমন সময় গ্রাম্য এক আরব সেখানে উপস্থিত হয়ে জিজ্ঞাসা করল, হে আল্লাহর রাসূল! কিয়ামত কবে হবে? হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) তার জিজ্ঞাসার জবাব না দিয়ে আলোচনা অব্যাহত রাখলেন। ফলে উপস্থিত লোকদের কেউ কেউ বলতে লাগল, নবী করিম (সা.) সে যা বলেছে শুনতে পেয়েছেন কিন্তু তার কথা তিনি পছন্দ করেননি। আবার কেউ কেউ বলল, আল্লাহর রাসূল তার কথা শুনতেই পাননি। এর পর বক্তব্য শেষ হলে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, প্রশ্নকারী কোথায়। সে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমি এখানে। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, যখন আমানতকে ধ্বংস করে ফেলা হবে, তখন কিয়ামতের জন্য অপেক্ষা করো। প্রশ্নকারী বলল, আমানত কিভাবে ধ্বংস হয়? হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, যখন অযোগ্য লোককে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হবে- তখন কিয়ামতের অপেক্ষায় থেকো। -সহিহ বোখারি

বিভিন্ন পর্যায়ে ক্ষমতার মসনদে মন্দ লোকদের সামাজিক উত্থান মূলতঃ কিয়ামতের আলামত। এ প্রসঙ্গে বর্ণিত এক হাদিসে অাছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন- হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যতদিন পর্যন্ত অশ্লীলতা ও কৃপণতা বৃদ্ধি না পাবে, আমানতদার ব্যক্তিকে খেয়ানতকারি ও খেয়ানতকারিকে আমনতদার মনে করা না হবে এবং সমাজের সম্ভ্রান্ত (বুউল) লোক ধ্বংস না হবে ও ইতর শ্রেণির (তুহুত) লোকের উত্থান না হবে- ততদিন পর্যন্ত কিয়ামত কায়েম হবে না। সাহাবারা জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! বুউল কি? আর তুহুত কি? হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, বুউল হলো- সমাজের দর্পণ অর্থাৎ সম্ভ্রান্ত শ্রেণির মানুষ, আর তুহুত হলো- ওই সমস্ত মানুষ; যারা মানুষের পায়ের নীচে অবস্থান করত, যাদেরকে মানুষ চিনত না। -আল মুজামুল আওসাত : ৩৮৯৩

সাধারণ মানুষের রায়ে জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হবেন, তাই সাধারণ মানুষের রায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটা একটি পবিত্র আমানত। এই আমানত সম্পর্কে কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহর দরবারে প্রত্যেককেই জবাবদিহি করতে হবে। যদি কেউ প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে জনগণের ওপর জুলুম ও সন্ত্রাস পরিচালনার সুযোগ পায়- তাহলে তাকে ভোটদানকারীরা কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহর দরবারে জিজ্ঞাসার সম্মুখীন হবেন এবং তার অপকর্মের দায়ভার রায়দানকারীদেরকেও কাঁধে নিতে হবে।

এ প্রসঙ্গে এক হাদিসে হজরত আওস ইবনে সুরাহবিল (রা.) বর্ণনা করেছেন। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি কোনো জালেমকে (অত্যাচারী), সে জালেম একথা জানার পরও তাকে সঙ্গ দিয়ে শক্তি বৃদ্ধ করলো- সে ইসলামের গন্ডির বাইরে চলে গেলো। -মিশকাত ও তাফসিরে মাজহারি।

পরিশেষে, একজন মানুষের মাঝে যদি সঠিক নেতৃত্বের গুণাবলী থাকে – তবে একদল অযোগ্য লোককেও তিনি অনেক বড় অর্জনের দিকে নিয়ে যেতে পারেন। নেতৃত্বের উক্তি দুর্বলের বুকে সাহস যোগায়, অবিশ্বাসীর মনে বিশ্বাসের জন্ম দেয়। মানুষ একা কিছু করতে পারে না। একজন মানুষের স্বপ্ন যত বড় – তার দলও তত বড় হতে হয়। একজন সত্যিকার নেতা তাঁর নিজের স্বপ্ন ছড়িয়ে দিতে পারেন বহু মানুষের মাঝে। নেতাকে অনুসরন করে তারা নিজের শ্রম, ঘাম – এমনকি রক্ত দিতেও দ্বিধা করে না।

লেখকঃ মোহাম্মদ হাসান, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।






মতামত দিন।

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*