প্রাণের ৭১

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এগিয়ে যেতে পারলে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় সার্থক হবে: মোহাম্মদ হাসান

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের দ্বারপ্রান্তে দেশ এমনই সন্ধিক্ষণে এবারের বিজয় দিবস। দিবসটির প্রাসঙ্গিকতায় যুক্ত হয়েছে নানা মাত্রা, নানা তাৎপর্য। জাতির চূড়ান্ত বিজয়ের দুর্লভ মুহূর্তগুলো নতুন প্রজন্মের ইতিহাসবোধ নির্মাণে নতুন উপাদান, নতুন দর্শন হাজির করছে। একটি মুক্তসমাজ গঠনের সংকল্পে বাঙালির এ উত্থান সে সময় খুব একটা স্বাভাবিক ঘটনা ছিল না।

বিশ্বে একটি মাত্র দেশ ‘বাংলাদেশ’। দু’শ বছরের শোষণ বঞ্চনা নিপিড়ন সয়ে শুধুমাত্র একজন বাঙালি সন্তান- যিনি মুজিব ভাই থেকে বঙ্গবন্ধু পরবর্তীতে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের আঙুলের ইশারায় মাত্র ৯ মাসে স্বাধীনতা অর্জন করেছে।

বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় হচ্ছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বাংলাদেশের অভ্যুদয়। এই গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের মহানায়ক হচ্ছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমাদের ‘মুক্তিযুদ্ধ’, ‘স্বাধীনতা’, ‘বাংলাদেশ’, ‘বঙ্গবন্ধু’ এই শব্দগুলো অবিচ্ছেদ্য। এগুলোকে সমার্থকও বলা যেতে পারে; একটিকে আরেকটি থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না।

ডিসেম্বর মাস আমাদের জাতির ‘বিজয়ের মাস’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী, সামরিক বাহিনী এবং তাদের সহযোগীরা পরাজয় স্বীকার করে আত্মসমর্থন করতে বাধ্য হয়। বিশ্বের বুকে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং জনগণ প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। ছাত্র-তরুণ সমাজের উদ্যোগ ছিল সকল সংগ্রামের ধারাবাহিক ঐতিহ্য।

আমাদের জনগণের দীর্ঘ সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের ঘোষণা প্রদান করেন। বীর জনগণ সর্বশক্তি নিয়ে আক্রমণকারী সশস্ত্র পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ৩০ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছেন। এক কোটি মানুষ দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। কোটি কোটি মানুষ নানাভাবে নির্যাতিত, নিপীড়িত, ক্ষতিগ্রস্থ, লুণ্ঠিত, অত্যাচারিত, মা-বোনের ইজ্জত-সম্ভ্রম, সব হারিয়ে লড়াই চালিয়ে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় পতাকা উড়িয়ে মাতৃভূমি স্বাধীন করেছেন।

মাতৃভাষা বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ও বিজয়ের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয়বাদের চেতনার যে বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল, পরবর্তীকালে তা স্বাধীনতার জন্য প্রস্ফুটিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে রূপ লাভ করেছিল। ষাটের দশকে সামরিক শাসন বিরোধী গণতন্ত্রের আন্দোলন, শিক্ষানীতির জন্য সংগ্রাম, সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুর উত্থাপিত ৬ দফা সংগ্রাম এবং ঊনসত্তরে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফার (যার মধ্যে ৬ দফা দাবি অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং এক নম্বর দাবি ছিল শিক্ষার দাবি) ভিত্তিতে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা (যার মূল উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা) প্রত্যাহারের ফলে বঙ্গবন্ধু মুক্তি লাভ করেন।

একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মহাসমাবেশে তৎকালীন জটিল পরিস্থিতি বিশ্লেষণ, নতুন করণীয় নির্ধারণ, স্বাধীনতার প্রস্তুতি ও সংগ্রামের নির্দেশনা দেন। ইতিহাসের এই অতুলনীয় ভাষণে তিনি ঘোষণা দেন:

“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”

এটাই ছিল প্রকৃত স্বাধীনতার ঘোষণা। ২৬ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী গণহত্যা শুরু করলে বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিকভাবে এবং জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত অধিকাংশ সদস্যের নেতা (প্রধানমন্ত্রী, যা সামরিক শাসকরা হতে দেয়নি) হিসেবে বৈধভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। জনগণের রায়ের ফলে যা আনুষ্ঠানিকভাবে বৈধতা লাভ করেছিল। ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর ঐক্যবদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি স্বাধীনতা অর্জন করে বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলো।

২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে বন্দি করে রাখে। তাঁকে তারা হত্যার চেষ্টা করেও আন্তর্জাতিক চাপের কারণে তা করতে সক্ষম হয়নি। বঙ্গবন্ধু বন্দি থাকায় স্বাধীনতা ও বিজয় ছিল অসম্পূর্ণ। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানি শাসকরা তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় এবং তিনি ১০ জানুয়ারি দেশে প্রত্যাবর্তন করেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে নস্যাৎ করে পরাধীন করে রাখার জন্য পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এবং তাদের আন্তর্জাতিক সহযোগী শক্তির সমর্থনে এবং বিশেষ করে বাংলাদেশের একটি বিশেষ মহল সব ধরনের হত্যা, লুট, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, মা-বোনের ইজ্জত লুটে নেওয়ার সঙ্গে সর্বাধিক সক্রিয় ছিল। এদের মধ্যে প্রধান শক্তি ছিল জামায়াতে ইসলামী ও তার সহযোগী ইসলামী ছাত্র-শিবির (তখন নাম ছিল ইসলামী ছাত্রসংঘ) এবং মুসলিম লীগের অধিকাংশ নেতা-কর্মীসহ সাম্প্রদায়িক, স্বাধীনতাবিরোধী কিছু শক্তি। মুক্তিযুদ্ধের শেষ ভাগে পরাজয় নিশ্চিত জেনে বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করার লক্ষ্যে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্র-শিবির পরিকল্পিতভাবে আমাদের বুদ্ধিজীবী শিক্ষক এবং সব ধরনের মেধাবীদের হত্যা করেছিল। এসব অপরাধীর অনেকের বিচার হয়েছে, মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে ও চলছে।

আজ অনেক ঘাত-প্রতিঘাত, উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, লক্ষ্য ও আদর্শের পথে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ‘সোনার বাংলা’ প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ২০২১ সালের মধ্যে ‘মধ্যম আয়ের’ রাষ্ট্র এবং ডিজিটাল বাংলাদেশের লক্ষ্য অর্জন করার অগ্রগতি দৃশ্যমান। ২০৪১ সালের মধ্যে আমরা একটি দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত রাষ্ট্রের পর্যায়ে উন্নত হতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। এ জন্য আমাদের নতুন প্রজন্মকে প্রস্তুত করার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের মূল লক্ষ্য আমাদের নতুন প্রজন্মকে আধুনিক উন্নত বাংলাদেশের নির্মাতা হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন।

আওয়ামী লীগ সরকার নতুন প্রজন্মকে বর্তমান যুগের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বিশ্বমানের শিক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তিতে দক্ষ এবং সততা, নিষ্ঠা, জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ ও শ্রদ্ধাশীল, নৈতিক মুল্যবোধসম্পন্ন, দেশপ্রেমে উজ্জীবিত পরিপূর্ণ মানুষ তৈরি করার মহান কর্মযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছেন । এই পথেই আমাদের দেশকে মর্যাদাশীল রাষ্ট্রে পরিণত করতে আমাদের সফল হতে হবে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ও আদর্শ এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সমগ্র জাতি সেই ধারাবাহিকতায় এগিয়ে যেতে সক্ষম হবে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিজয় সার্থক হবে।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর যে পরিবর্তনগুলো সমাজমনে দীর্ঘমেয়াদি ছাপ ফেলতে শুরু করল, তা হল রাষ্ট্রীয় মদদে অনৈতিকতার অনুশীলন। হয়তো শুরুটা তার ইনডেমনিটি দিয়ে। পেশি ও অন্যায়কে রাষ্ট্রীয়ভাবে ন্যায্যতা দেয়া হল। রাজনীতি ও অর্থনীতির চরিত্র বদলে যেতে লাগল। রাজনীতির ঐতিহ্য ও বিশুদ্ধতাকে কালিমালিপ্ত করার দম্ভোক্তি এলো প্রকাশ্যে। অনৈতিকতাকে প্রশ্রয় দিয়ে রাতারাতি বড়লোক হওয়ার লোভ উসকে দেয়া হল।

আজ যারা ধর্মীয় মূল্যবোধের শুদ্ধতার প্রশ্নে উচ্চকণ্ঠ, তারা দুর্নীতির বিস্তার নিয়ে কথা বলে না, খুন-ধর্ষণ-অগ্নিসংযোগ নিয়ে কথা বলে না। শিশুনিগ্রহ, নারী নির্যাতন প্রসঙ্গে নীরব; এমন কী বিদেশে ধর্মীয় নিপীড়নের প্রশ্নেও এরা সাবধানী, কৌশলী। অর্থাৎ এদের লক্ষ্য রাজনীতি, আর তা নিয়ন্ত্রণ করে নেপথ্যের খেলোয়াড়রা। রাষ্ট্রপরিচালনায় যারা থাকেন, তারাও সময়ে-অসময়ে এদের কাজে লাগান। কাজেই নৈতিক অবস্থান এদের দুর্বলই থাকে।

কেউ অস্বীকার করবে না, দেশ এগিয়েছে অনেকটা পথ। করোনাকালেও দেশের অর্থনীতি তার অন্তর্গত সামর্থ্য প্রমাণ করেছে। তবে উন্নয়নকে টেকসই করতে হলে সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রয়োজন। নৈতিক অবক্ষয়, অসহিষ্ণুতা কিংবা উগ্রবাদের বিস্তার রুখে দেয়ার জন্য জনগণের ঐক্য চাই। জনগণের সার্বভৌমত্বই হল গণতন্ত্রের সারকথা। রাষ্ট্রের চরিত্র নির্ধারিত হয় সাংবিধানিক মূল্যবোধের আলোকে। রাজনীতি, অর্থনীতি, বিদেশনীতি, গণতন্ত্র; এমন কী ধর্ম বিষয়েও আমাদের নৈতিক অবস্থান দৃশ্যমান হওয়া উচিত।

রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি, জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, সরকারি দল-বিরোধীদলের সম্পর্কোন্নয়ন, নির্বাচন ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি; সর্বোপরি রাজনৈতিক দলগুলোর দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন জরুরি।

লেখকঃ মোহাম্মদ হাসান, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।






মতামত দিন।

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*