প্রাণের ৭১

১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে ৭১দেশ স্বীকৃতি দেয় বাংলাদেশকে

১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে ৭১টি দেশ স্বীকৃতি দেয় বাংলাদেশকে

মোহাম্মদ হাসানঃ একটি দেশের পররাষ্ট্রনীতি দেশটির অভ্যন্তরীণ নীতির সম্প্রসারিত ও সংযােজিত অংশ। জাতীয় মূল্যবােধের প্রতিফলন পররাষ্ট্রনীতির একটি বড় মাপকাঠি।পররাষ্ট্রনীতির মধ্যে নৈতিকতার পাশাপাশি কূটনৈতিক দক্ষতা থাকাও প্রয়ােজন। রক্তাক্ত মুক্তিসংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে ভৌত অবকাঠামাে ছিল দুর্বল। তাই শুরু থেকেই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য ছিল দ্রুত আর্থসামাজিক পুনর্গঠনের লক্ষ্যে প্রয়ােজনীয় বৈদেশিক সাহায্য, ঋণ ও কারিগরি সহযোগিতা নিশ্চিত করা। কাজেই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির দুটি লক্ষ্য ছিল। যথা-কূটনৈতিক স্বীকৃতি আদায় করা ও বৈদেশিক অর্থনীতি (Foreign Economic Policy ) অর্থাৎ সাহায্য-সহযােগিতা অর্জন করা। ১৯৭० সালের নির্বাচনের পূর্বে দেয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির আভাস ছিল। সেই রূপরেখা অনুযায়ী মুজিবনগর সরকারও একই পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে। যুদ্ধ চলাকালীন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেন,

We do not aspire to join any bloc or pact but will seek assistance from those who give it in a spirit of goodwill free from any desire to control our destinies.

পরবর্তীকালে স্বাধীন দেশেও সকলের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতিতে পথ চলা শুরু হয়।

পররাষ্ট্রনীতির উদ্দেশ্যঃ
সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় জোটনিরপেক্ষ ও স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে। ১৯৭২ সালের ১৫ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু বলেন, “সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়” এমন নীতির দ্বারা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি পরিচালিত হবে। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তি ব্যবহার থেকে নিরস্ত থাকবে এবং নিরস্ত্রীকরণের জন্য সচেষ্ট হবে। অবশ্য যুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশ ভারতকে অবহিত করেছিল যে স্বাধীন দেশে পররাষ্ট্রনীতির আদর্শ হবে- ক. জোটনিরপেক্ষতা, খ. শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, গ. উপনিবেশবাদ, বর্ণবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরােধিতা। ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর স্বাধীন দেশের পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে খন্দকার মােশতাক অনুরূপ নীতির কথা পুনর্ব্যক্ত করেন।

স্বাধীন রাষ্ট্রের
স্বীকৃতি ও কূটনীতিঃ
স্বীকৃতি আদায়ের কূটনীতি দুটো পর্বে বিভক্ত ছিল। যথা- ক. মুক্তিযুদ্ধকাল, খ. মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী অর্থাৎ স্বাধীন দেশে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রবাসী সরকারের আন্তরিক ও সর্বাত্মক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও শুধুমাত্র ভারত ও ভুটান ছাড়া অন্য কোনাে দেশের স্বীকৃতি আদায় করা সম্ভব হয়নি। ১৯৭১ সালের ২৪ এপ্রিল প্রবাসী সরকার স্বীকৃতির জন্য ভারতের কাছে প্রথম আবেদন করে। কিন্তু পরবর্তীতে আরাে কয়েকবার আবেদনের পর ৬ ডিসেম্বর (১৯৭১) ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। ভুটান ৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়।

দ্বিতীয় পর্বে স্বীকৃতি আদায় করা তুলনামূলক সহজ ছিল। কিন্তু তখনও পাকিস্তান ও বাংলাদেশ বিরােধী শক্তিদের অপপ্রচারের কারণে অনেক রাষ্ট্রই তখন স্বীকৃতি দেয়নি। যেমন—মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ব্রিটেন এবং সােভিয়েত ইউনিয়নসহ বিশ্বের অনেক মুসলিম ও প্রতিবেশী রাষ্ট্র।

১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি পূর্ব জার্মানি, মঙ্গোলিয়া, পােল্যান্ড ও বুলগেরিয়া বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারির মধ্যে ৭১টি দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। ফেব্রুয়ারি মাসে গ্রেট-ব্রিটেন, পশ্চিম জার্মানি, জাপান, ইতালি, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার মতাে প্রভাবশালী রাষ্ট্রসমূহ স্বীকৃতি দেয়। পাকিস্তানের বিরােধিতা সত্ত্বেও। কমনওয়েলথভুক্ত অনেক দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। আরব বিশ্বে ইরাক বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃতি দেয়। ওআইসিসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার চাপের মুখে ১৯৭৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। বঙ্গবন্ধুর দক্ষ কূটনৈতিক উদ্যোগের ফলে বাংলাদেশ ১২৮টি দেশের স্বীকৃতি লাভ করতে সক্ষম হয়, যা বঙ্গবন্ধু সরকারের বড় রকমের সাফল্য।

আন্তর্জাতিক
সংস্থাসমূহের সদস্যপদ লাভঃ
বঙ্গবন্ধু সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরই উপলব্ধি করে যে, দেশের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতিকে সাফল্যমণ্ডিত করতে হলে আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের সদস্যপদ লাভ করা দরকার। তাই প্রথমেই জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক দিক দিয়ে সর্বতােভাবে কাম্য ছিল। ১৯৭২ সালের ৮ আগস্ট বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদের জন্য আবেদন করে। কিন্তু চীনের ভেটো প্রয়ােগের ফলে তা বাতিল হয়ে যায়। ১৯৭৪ সালের মে-জুন মাসে আবেদনপত্রটি পুনর্বিবেচনা করা হয়। ১৯ সেপ্টেম্বর (১৯৭৪) সাধারণ পরিষদে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হবার ফলে বাংলাদেশ ১৩৬তম দেশ হিসেবে জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে। ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভায় অংশ নেন। সেখানে তিনি বাংলায় ভাষণ দেন। সেখানে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির ব্যাখ্যা তুলে ধরেন। বঙ্গবন্ধু সরকার ১৯৭২ সালের ১০ মে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে সদস্যপদ লাভ করে। ১৯৭৩ সালের মে মাসে ঢাকায় বিশ্ব শান্তি পরিষদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এশীয় শান্তি সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু জুলিও কুরি পদক লাভ করেন। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে কমনওয়েলথ, ইসলামি সম্মেলন সংস্থার সদস্যপদসহ ১৪টি আন্তর্জাতিক সংগঠনের সদস্যপদ লাভ করেন। বাংলাদেশের সামগ্রিক পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত বৈদেশিক নীতির ভিত গড়ে ওঠে। যেমন:

প্রথমত : পররাষ্ট্রনীতির মৌল ভিত্তি এবং কাঠামাে এ সময়েই রচিত হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে যা হয়েছে তা মূল পরিবর্ধন ও কৌশলগত পরিবর্তন।

দ্বিতীয়ত : ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫-এর পররাষ্ট্রনীতি বিকাশে এবং বৈপ্লবিক ব্যবহারের সঙ্গে প্রয়ােজনীয় সেতুবন্ধ রচনায় ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুর ভাবমূর্তি ও ভূমিকা লক্ষণীয়।

তৃতীয়ত : প্রয়ােজনে সমাজতান্ত্রিক ব্লক থেকে পশ্চিমা দেশের সঙ্গেও হৃদ্যতা।

বঙ্গবন্ধুর আমলে গৃহীত ১৯৭২ সালের সংবিধানেও লক্ষ করা যায় জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও সমতার প্রতি শ্রদ্ধা, অন্যান্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, আন্তর্জাতিক বিরােধের শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং আন্তর্জাতিক আইনের ও জাতিসংঘের সনদে বর্ণিত নীতিসমূহের প্রতি শ্রদ্ধা।

সূত্রঃ ইয়াসিন কবির জয়’র ফেসবুক পেজ।






মতামত দিন।

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*