প্রাণের ৭১

৭ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধা হত্যা দিবসে

একাত্তরে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী তাঁর কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারেনি। কিন্তু তাঁকে আমরা বাঁচিয়েও রাখিনি। স্বাধীন ও সার্বভৌম সেই রাষ্ট্রেই তাঁকে হত্যা করা হয়, যে রাষ্ট্র অর্জনের জন্য তিনি প্রবল বিক্রমে লড়েছিলেন ও লড়াই করিয়েছিলেন অগণিত দুঃসাহসী গেরিলা যোদ্ধাকে।

 

হ্যাঁ, বলছি মেজর আবু তাহের মোহাম্মদ হায়দারের কথা। এ,টি,এম, হায়দার এবং মেজর হায়দার নামেই যাকে আমরা চিনি।

 

মো. ইসরাইল মিয়া ও হাকিমুন্নেসার পুত্র এটিএম হায়দারের জন্ম কলকাতার ভবানীপুরে, ১৯৪২ সালের ১২ জানুয়ারি। দুই ভাই ও তিন বোনের মধ্যে হায়দারের স্থান দ্বিতীয়। পাবনা জেলার বীণাপানি স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের পর ১৯৫৮ সালে কিশোরগঞ্জ রামানন্দ হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক, ১৯৬১ সালে কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল সরকারি কলেজ থেকে আইএ এবং ১৯৬৩ সালে লাহোর ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএসসি পাস করেন।

 

লাহোরের পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটি থেকে পরিসংখ্যানে এমএসসি প্রথম পর্ব সমাপ্তির পর সামরিক বাহিনীতে কমিশন্ড পদে মনোনীত হন। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। তিনি প্রথমে কাকুলে ট্রেনিং নেন এবং কমিশন প্রাপ্তির পর গোলন্দাজ বাহিনীর অফিসার হিসেবে নিয়োজিত হন। চেরাটে এমএসজি (স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপ) ট্রেনিংয়ে অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে একজন দক্ষ গেরিলা কমান্ডার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।

 

কমান্ডো ট্রেনিংয়ে ৩৬০ জনের মধ্যে মাত্র দুজন বাঙালি অফিসার ছিলেন। কমিশন প্রাপ্তির পর ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত তিনি, তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের মুলতান ক্যান্টনমেন্টে কর্মরত ছিলেন। ১৯৬৯ সালের শেষের দিকে তৃতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নের একজন ক্যাপ্টেন হিসেবে তাঁকে কুমিল্লা সেনানিবাসে পাঠানো হয়। ১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে তাঁকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। ১৫-২০ দিন পর পুনরায় কুমিল্লায় নিয়োগ করা হয়।

 

১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ কুমিল্লা সেনানিবাস ত্যাগ করেন এবং ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায় চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসারদের সঙ্গে মিলিত হন। সেখান থেকে তিনি তেলিয়াপাড়া যান এবং কিছু সংখ্যক সৈন্যসহ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। তিনি ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ মহাসড়কসহ মুসল্লী রেলওয়ে সেতু বিস্ফোরকের সাহায্যে উড়িয়ে দেন। এরপর তিনি মেলাঘরে সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফের অধীনে সেকেন্ড কমান্ডার নিযুক্ত হন। ক্যাপ্টেন হায়দার মেলাঘরে ছাত্রদের নিয়ে একটি কোম্পানি গঠন করেন এবং গেরিলাদের কমান্ডো ও বিস্ফোরক বিষয়ক প্রশিক্ষণ দানের দায়িত্ব পালন করেন।

 

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান নিয়ে আমাদের বলার কিছু নেই। সেক্টর ২ এর অধীনে পরিচালিত গেরিলা অপারেশনগুলো এবং তাঁর হাতে গড়া গেরিলা’গণ সেই উজ্জ্বলতম অবদানের সাক্ষ্য হিসেবে ইতিহাসের পাতায় জাজ্বল্যমান।

 

১৯৭৫ সাল, স্বাধীন দেশের বয়স তখনো ৪ বছর হয়নি। ৬ই নভেম্বর (১৯৭৫) বাবার টেলিগ্রাম পেয়ে পারিবারিক কাজে বান্দরবানের রামু থেকে ঢাকায় এসেছিলেন হায়দার। সেদিন দুপুরে তিনি জেনারেল ওসমানী ও সেনাবাহিনীর কয়েকজন বন্ধুর সাথে দেখা করেন। একই দিন সন্ধ্যায় তাঁর প্রিয় সেক্টর কমান্ডার এবং নতুন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফের সাথে তার যোগাযোগ হয়। সে রাতে তাঁর সাথে বঙ্গভবনে যান।

 

সিপাহী বিপ্লবের খবর পেয়ে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর রাত ১২ টায় বঙ্গভবনে সিপাহী বিপ্লবের খবর পেয়ে জেনারেল খালেদ কর্নেল হুদা ও কর্ণেল হায়দারকে সঙ্গে নিয়ে প্রথমে ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামানের বাসায় যান। সেখান থেকে ভোর প্রায় ৩ টায় জেনারেল খালেদ কর্নেল হুদা ও কর্ণেল হায়দার শেরে বাংলা নগরে অবস্থিত ১০ম বেঙ্গল রেজিমেন্টে যান! উল্লেখ্য এই রেজিমেন্টের তৎকালীন কমান্ডিং অফিসার ছিলেন কর্নেল নওয়াজিস।

৭ই নভেম্বর ভোরবেলা, কথিত সিপাহী বিদ্রোহের প্রবল ঢেউ ১০ম বেঙ্গলে এসে পড়ে। পরিস্থিতি কর্নেল নওয়াজিসের নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যায়। আফিসার মেসে বসে খালেদ মোশাররফ,হায়দার  এবং হুদা সকালের নাস্তা করছিলেন।

 

এমন সময় মেজর জলিল (জাসদ নেতা ও মুক্তিযোদ্ধা মেজর জলিল নন), ক্যাপ্টেন আসাদ কয়েকজন উত্তেজিত সৈনিক নিয়ে মেসের ভিতর প্রবেশ করে। তার সাথে একজন হাবিলদারও ছিল।

 

ওই মেজর জলিল চিৎকার দিয়ে জেনারেল খালেদকে বলল-“আমরা তোমার বিচার চাই”!

 

জেনারেল খালেদ শান্তকণ্ঠে জবাব দিলেন,” ঠিক আছে , তোমরা আমার বিচার করো। আমাকে জিয়ার কাছে নিয়ে চলো।”

 

স্বয়ংক্রিয় রাইফেল বাগিয়ে হাবিলদার চিৎকার করে বললো-“আমরা এখানেই তোমার বিচার করবো।”

 

ধীর স্থির জেনারেল খালেদ বললেন, ” ঠিক আছে, তোমরা আমার বিচার করো”

 

খালেদ দু’হাত দিয়ে তার মুখ ঢাকলেন।

 

একটি ব্রাস ফায়ার।

 

মেঝেতে লুটিয়ে পড়লেন সেনাবাহিনীর চৌকস অফিসার বীর মুক্তিযোদ্ধা জেনারেল খালেদ মোশাররফ যার ললাটে ছিল বীরযোদ্ধার জয়টিকা, মাথায় ছিল মুক্তিযুদ্ধের বীর উত্তমের শিরোপা আর মাথার বাম পাশে ছিলো পাকিস্তানী গোলন্দাজ বাহিনীর কামানের গোলার গভীর ক্ষতচিহ্ন।

 

কামরার ভেতরেই গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান






মতামত দিন।

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*