প্রাণের ৭১

কেন চিকিৎসকরা গ্রামে থাকতে চান না?

বিসিএস চাকরিতে প্রবেশের পর বাধ্যতামূলক যে দুই বছর উপজেলা লেভেলে ছিলাম তার অধিকাংশ সময়ই ছিল বেশ সুখকর। যদিও কিছু সহকর্মীর আচরণে কখনওবা অসুস্থ বাবাকে রেখে দূরে থাকার দুশ্চিন্তা সেই সুখের মাঝে অসুখ হিসেবে এসেছিল। কিন্তু দু’একটি ঘটনা ছাপিয়ে গিয়েছিল সবকিছু।

আমার প্রথম পোস্টিং বাসা থেকে আসা-যাওয়া করে করা দূরত্বে হলেও বরিশাল বিভাগের সর্ব দক্ষিণের একটি উপজেলায় চিকিৎসক সংকট মোচনে ‘বাবুরাম সাপুড়ের নির্বিষ মার্কা’ চিকিৎসক খোঁজা শুরু হল। তখন নিরীহ হিসেবে আমিই ধরা খেলাম। এবং পত্রপাঠ দ্বীপান্তর। কিছুটা মন খারাপ নিয়েই গিয়েছিলাম সেই কর্মস্থলে, কিন্তু সমবয়সী সহকর্মীদের উষ্ণ আলিঙ্গনে মুহূর্তেই কেটে গিয়েছিল সেই ভাব।

আমার সেই কর্মস্থলে এক সিনিয়র ভাই ছিলেন আরএমও যাকে সরকারি কর্মকর্তার বদলে সুফি দরবেশ হিসেবেই বেশি মানাতো। বন্যেরা বনে সুন্দর, তেমনি ভাইকে মসজিদে ভাল মানালেও অফিসে তিনি ছিলেন খুবই আনফিট। যদিও তার কাজ তিনি করতেন, কিন্তু ইনডোর আউটডোরের বস হিসেবে একদমই বেমানান। উপজেলায় কোনো নারী চিকিৎসক না থাকায় ভাইয়ের স্ত্রীও (এমবিবিএস ডাক্তার যদিও বিসিএস দেন নাই) কিন্তু প্রাইভেট প্র্যাকটিস জমিয়ে ফেলেছিলেন বেশ।

ভাই, ভাবী আর ১০/১২ বছরের কোমলমতি মেয়েকে নিয়ে সেই গহীন উপজেলাতেই বেশ সুখের সংসার সাজিয়ে বসেছিলেন। এমনই একদিন আমি ইমার্জেন্সীতে ডিউটিতে ছিলাম, মাগরিবের নামাযের পরপরই হঠাৎ হাসপাতাল জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল চাপা উত্তেজনা।

রোগী সেজে আসা এক ভবঘুরেকে আটক করা হয়েছে। যে কিনা ভাইয়ের শিশুকন্যাকে ভুলিয়ে নিয়ে গিয়েছিল কোয়ার্টারের পেছনে গহীন বনে। হয়তো আল্লাহ ভাইকে ভালবাসতেন তাই বড় কোন বিপদ হবার আগেই আমাদের এক স্টাফ হাতে নাতে ধরে ফেলে সেই নরপিশাচকে।

ধরে নিয়ে আসা হল আমার কাছে। আমার মাথায় তখন আগুন জ্বলছে। শুনলাম, এর আগেও এই পেডফাইল পার্ভার্ট স্থানীয় স্কুলের শিশুদের ওপর অত্যাচার চালিয়েছে। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে বেশি দিন জেলে থাকে না সে। তবে তার জেলে না থাকার কারণ বুঝতে বেশিক্ষণ লাগে নাই আমার। কিছুক্ষণের ভেতর স্থানীয় এক নারী জনপ্রতিনিধির আগমণ। ইনিয়ে-বিনিয়ে অনেক কথার পর তার মূল বক্তব্য-‘শিশুটির মা কেন তার খোঁজ রাখেনি। সারা দিন চেম্বার নিয়ে ব্যস্ত থাকলে এমনই তো হবে।’

আমি তাকালাম মাথা নিচু করে বসে থাকা আরএমও -এর দিকে। অসহায় কিংকর্তব্যবিমুঢ় এক পিতা তার সন্তানকে কালিমা থেকে বাঁচাতেই হোক অথবা স্থানীয় চাপেই হোক, একটি মামলা করেছিলেন। মামলাটি ছিল হালকা একটি চুরির মামলা। আমি জানি, এ মামলা হয়ত কোর্ট পর্যন্তও যাবে না, ওই পেডফাইল আবার বেরিয়ে আসবে, সর্বনাশ করবে অসংখ্য শিশুর।

ওই উপজেলার এমপি সাহেব সংসদে দাঁড়িয়ে অভিযোগ করেছেন, কেন তার উপজেলায় নারী চিকিৎসক নেই, কেন চিকিৎসকরা থাকতে চান না গ্রামে। এমপি সাহেব ও সব নীতিনির্ধারকদের বলব উত্তরটা খুব একটা কঠিন কিছু না। সার্ভিস দেয়ার নূন্যতম পরিবেশটুকু দিন, আমরাই ছুটে যাব। সার্ভিস দিতে যেয়ে মার খেয়ে রেপড হয়েও সেবা দান করে যেতে হবে এটা কি সার্ভিস বুকে লেখা রয়েছে?

লেখক: ডা. রেজওয়ান রেজা, মেডিকেল অফিসার, শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, বরিশাল






মতামত দিন।

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*