প্রাণের ৭১

যত সব দোষ মেয়েদের!

সাত বছর আগে ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি খুন হন সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি। তখন খুনের জন্য রুনির বিরুদ্ধে পরকীয়ার অভিযোগ আনা হয়। নানা তথ্য ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এমনকি ‘হত্যা রহস্যের কেন্দ্রে রুনি’ ও ‘হত্যার কারণ কি রুনি’ এমনতর নানা খবর প্রচার হয় গণমাধ্যমেও। দেশ রুপান্তর

 

 

 

 

সাত বছর পর সর্বশেষ গত বুধবার বরগুনায় স্ত্রী আয়েশা আক্তার মিন্নির সামনে প্রকাশ্যে কুপিয়ে খুন করা হয় স্বামী রিফাত শরীফকে। কুপিয়ে মারার সে দৃশ্যের ভিডিও তোলপাড় তোলে সারা দেশে। কিন্তু সাগর-রুনির মতো এবারও খুনের দায় পড়ে কলেজ পড়য়া মিন্নির ওপর। খুনের জন্য প্রধান তিন খুনির একজনের সঙ্গে মিন্নির প্রেমকে কারণ দেখিয়ে নানা অপপ্রচার চলছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। প্রচার করা হচ্ছে ওই খুনির সঙ্গে বিয়ের কাগজপত্র, এমনকি অন্তরঙ্গ ছবিও।

 

 

 

 

শুধু সাগর-রুনি বা রিফাত হত্যাকা-ই নয়; গত সাত বছরে অন্তত চারটি বড় ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্য ঘুরেফিরে সেই নারীকেই হেয় করা হয়েছে। কখনো নিজে খুনের শিকার হয়ে, কখনো স্বামীর খুন হওয়ার পেছনে ওই নারী বা স্ত্রীর পরকীয়ার অপবাদ দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে আসামিপক্ষের লোকজন ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে এমনতর  নানা তথ্য ছড়িয়ে দেয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এমনকি এ নিয়ে কথা বলতে ছাড়েননি মন্ত্রী, সাংসদরাও। অথচ এখন পর্যন্ত এই চারটি খুনের ঘটনায় নারীর বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি।

 

কেন এমন হচ্ছে? জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাদেকা হালিম দেশ রূপান্তরকে বলেন, মূল ঘটনাকে আড়াল করতে ও অন্যদিকে প্রবাহিত করতেই এসব করা হয়। যেহেতু আমরা নারীকে এখনো মানুষ হিসেবে দেখি না, নারী হিসেবেই দেখি এবং নারীর বিরুদ্ধে যেকোনো অপপ্রচার বা নৃশংসতা চালিয়ে পার পেয়ে যাই, তাই এই প্রবণতা বন্ধ হচ্ছে না। এই শিক্ষক বলেন, দেখুন, আমরা এখনো নারীকে পূর্ণ সম্মান দিতে দেখি না। মানুষ হিসেবে দেখি না। নারীর বিরুদ্ধে যেকোনো কথা বলতে পারি ও পার পেয়ে যাই। গত কয়েক বছরে যেসব নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, তার সবগুলোতেই নারীকে হেয় করা হয়েছে। নারীদের চরিত্র হনন করা হয়েছে। অপরাধীরা এসব করে পার পেয়ে গেছে বলেই এই প্রবণতা এখনো অব্যাহত। কারণ এখনো এসব হত্যাকাণ্ডর বিচার হয়নি। এই বিচারহীনতাও এসব অপবাদ প্রচারণায় সাহস জোগাচ্ছে।

 

এর সর্বশেষ উদাহরণ নুসরাত হত্যাকণ্ডে উল্লেখ করে সাদেকা হালিম বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তিনি এ ঘটনায় হস্তক্ষেপ না করলে নুসরাতের চরিত্র হরণ হতো। তার মানে আমরা নারীর ক্ষমতায়নের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাচ্ছি, কিন্তু নারী মর্যাদা পাচ্ছে না। আমি পরিষ্কার বলতে চাই, নারী মানুষ। তাকে মানুষের মর্যাদা দিতে হবে। এসবের মধ্য দিয়ে আমরা প্রকৃত ঘটনা চাপা দিতে পারি না।

 

এ ব্যাপারে মানবাধিকার আইনজীবী সালমা আলী বলেন, যেখানে নারীর সিমপ্যাথি পাওয়া উচিত, তার পাশে দাঁড়ানোর কথা, সেখানে আমরা তার বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার চালাচ্ছি। চরিত্র হরণ করছি। মিথ্যে তথ্য প্রচার করে সামাজিক মর্যাদা নষ্ট করছি। মানসিকভাবে কষ্ট দিচ্ছি। এটা হচ্ছে আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের কারণে। এখনো আমরা পুরুষতান্ত্রিকতায় বিশ্বাসী। যে কারণে একজন নারী খুনের শিকার হলে বা তার স্বামী খুন হলে সেই নারীকেই আমরা খলনায়িকা বানিয়ে দিচ্ছি। অথচ এমনটা পৃথিবীর কোথাও নেই।

 

এই মানবাধিকারকর্মী বলেন, তনুর ঘটনা আমি নিজে তদন্ত করেছি। সে থিয়েটার করত। সবাই তাকে খুব ভালোবাসত। প্রশংসা করত। অথচ ওর বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য প্রচার করা হয়েছে। রিফাত হত্যায় সরকারদলীয় এমপিরা পর্যন্ত মিথ্যা অপবাদ দিয়ে ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দিচ্ছে। এমন আচরণ চলতে থাকলে নারীরা বিচার পাবে না। পরবর্তী সময়ে সে আবারও নির্যাতনের শিকার হবে। এটা আইন করে বন্ধ করা যাবে না। পরিবার থেকে শেখাতে হবে। আন্দোলন আকারে নিতে হবে। বিশেষ করে ইয়ুথ গ্রুপকে এগিয়ে আসতে হবে।

@নতুন সময়






মতামত দিন।

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*