প্রাণের ৭১

ঈদ এলেই সড়কে, যানবাহনে জোড়াতালি।

প্রতিবার ঈদ এলেই সড়ক-মহাসড়ক মেরামতের তোড়জোড় শুরু হয়। মন্ত্রণালয় থেকে সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। সড়কমন্ত্রী মহাসড়কে ছোটাছুটি করেন, কিন্তু ঈদে ভাঙা সড়ক আর যাত্রীদের দুর্ভোগ—দুই-ই থেকে যায়। এবারও মন্ত্রীর হাঁকডাকের পর জোড়াতালির মেরামত শুরু হয়েছে। কিন্তু কাজ শেষ করতে পারেনি সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর। ফলে ঈদযাত্রায় শঙ্কা রয়েই গেছে। বৃষ্টি বাড়লে এই শঙ্কা আরও বাড়বে বলে মনে করছেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরে সওজের অধীনে মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ খাতে ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এর অধীনে ছোট ও বড় মেরামত (পিরিয়ডিক মেইনটেন্যান্স) করার কথা। এ ছাড়া দৈনন্দিন মেরামতও এই খাত থেকে হয়। বড় মেরামতের জন্য সারা দেশে ১৬০টি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। যার ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। এসব প্রকল্পের ঠিকাদার নিয়োগ করতেই প্রায় ছয় মাস চলে যায়। আর কাজ শুরু হয়েছে বর্ষা শুরুর পর। প্রতিবারই একই প্রক্রিয়ায় বড় মেরামতকাজ সম্পন্ন করা হয়।
সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, গত ৯ বছরে সড়ক ও সেতু মেরামত এবং রক্ষণাবেক্ষণ খাতে প্রায় সাড়ে ২৭ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এর বাইরে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের অধীনে সড়ক নির্মাণ ও মেরামতের কাজ করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, বড় ও ছোট মেরামতের বাইরে দৈনন্দিন মেরামত সারা বছরই হওয়ার কথা। কিন্তু এগুলোও জুনে অর্থবছর শেষ হওয়ার আগে আগে করা হয়। এ সময়টাতে আবার বর্ষা মৌসুমও। কয়েক বছর ধরে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ঈদ। ঢাকা ও এর আশপাশ থেকে প্রায় সোয়া কোটি মানুষ ঈদে বিভিন্ন জেলায় যায়। বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার হিসাবে এর ৫৫ শতাংশই সড়কপথে যাতায়াত করে। ঈদ উৎসবের চাপে বর্ষায় জোড়াতালির যে মেরামত হয়, তা অনেকটাই অপচয় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞ ও যাত্রী অধিকার নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিরা।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী প্রথম আলো র কাছে দাবি করেন, ঈদের আগে কর্মকর্তাদের সময় বেঁধে দেওয়ার যে রেওয়াজ চালু হয়েছে, এতে কাজের কাজ কিছুই হয় না। সিংহভাগ অর্থই লুটপাট ও অপচয় হয়। আর জোড়াতালির সামান্য যে কাজ হয়, যানবাহনের চাকার সঙ্গে তা ভেসে যায়। সারা বছর একতালে মেরামত করতে হবে।
সারা দেশে সওজের অধীনে সড়ক আছে প্রায় ২১ হাজার কিলোমিটার। সংস্থাটির মহাসড়ক উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা (এইচডিএম) সার্কেলের গত ১৭ মে প্রকাশিত সমীক্ষা প্রতিবেদন বলছে, ৮০০ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক, ৯২০ কিলোমিটার আঞ্চলিক মহাসড়ক এবং ৩ হাজার কিলোমিটার জেলা সড়ক বেহাল অবস্থায় আছে। তিন ধরনের সড়কের ২৫ শতাংশ খারাপ। এসব সড়ক মেরামতে তাৎক্ষণিকভাবে ১১ হাজার ৮৮৪ কোটি টাকা দরকার বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
জানতে চাইলে সড়ক বিভাগের সচিব নজরুল ইসলাম
প্রথম আলোকে বলেন, ৮ জুনের মধ্যে সব মেরামত করার কথা বলার অর্থ এই নয় যে সব কাজ এই সময়েই হবে। মেরামতের প্রকল্প এক-দুই বছরের, তবে ঈদে যাতে সড়ক চলাচলে সমস্যা না হয়, সে জন্যই এমন নির্দেশনা।
সচিব দাবি করেন, গত বছর বর্ষাকাল বেশি সময় ধরে চলেছে। বন্যায় সাড়ে পাঁচ হাজার কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এবার বর্ষা একটু আগে শুরু হয়েছে। এরপরও সড়ক চলাচলের উপযোগী করা হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে সচিব স্বীকার করেন, বেশির ভাগ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয় জুন মাসে। এ জন্য বছরের শেষ দিকে ঠিকাদারদের তৎপরতা একটু বেশি থাকে।
সড়কের অবস্থা
গত ১৯ মে গাজীপুরের কালিয়াকৈরের সূত্রাপুর এলাকায় মহাসড়কের কাজ পরিদর্শনে গিয়ে সড়ক বিভাগ, জেলা প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে করেন ওবায়দুল কাদের। তখন তিনি ৮ জুনের মধ্যেই সড়কের মেরামত শেষ করার নির্দেশ দেন। কিন্তু কয়েক দিন ধরেই ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের টঙ্গী থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার এলাকার বিভিন্ন স্থানে পানি জমে আছে। সড়কও ভাঙাচোরা। সড়কটির এ দুরবস্থা তিন মাস ধরেই। নালা ও কারখানার নোংরা পানি সড়কের দুই পাশেরই প্রায় অর্ধেক অকেজো করে রেখেছে। ফলে এই ১২ কিলোমিটার পাড়ি দিতে গড়ে তিন ঘণ্টা সময় বাড়তি লাগছে। ভোগড়া বাইপাস থেকে চন্দ্রা মোড় পর্যন্ত সড়কের অবস্থাও একই।
ঢাকা-ময়মনসিংহসহ দেশের ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কের খানাখন্দ ও দুর্ভোগ নিয়ে ১ জুন থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। তিন দিন ধরে প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা পুনরায় এসব স্থান সরেজমিন ঘুরে সামান্য উন্নতি দেখতে পান।
একনজরে
* ঢাকা–রংপুর মহাসড়কের বগুড়া ও সিরাজগঞ্জ অংশে রাস্তা পুরোপুরি সংস্কার হয়নি
* ঢাকা–ময়মনসিংহ মহাসড়কের আবদুল্লাহপুর থেকে চন্দ্রা পর্যন্ত ভোগান্তি থাকছেই
* ঢাকা–সিলেট মহাসড়কে ভুলতা ও ওসমানীনগরে ভোগান্তির শঙ্কা
* ঢাকা–বরিশাল মহামহাসড়কে সংস্কারের মধ্যেই খানাখন্দ
* ঢাকা–খুলনা সড়কেও যাত্রীদের জন্য অপেক্ষা করছে ভোগান্তি
এর মধ্যে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের টঙ্গী থেকে জয়দেবপুর অংশের ১২ কিলোমিটার মহাসড়কের দৃশ্যত কোনো উন্নতি হয়নি। ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ ভোগড়া বাইপাসে খানিক ভালো খানিক খারাপ—এভাবে চলছে কয়েক মাস ধরে। এই বাইপাস ধরে উত্তরবঙ্গের যানবাহন চলাচল করে।
ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের চন্দ্রা থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত চার লেনের কাজ প্রায় শেষ। তবে সড়ক বিভাজক দেওয়া হয়নি। ফলে এখনো পুরোদমে এর ব্যবহার করা যাচ্ছে না। আর ২৩টি কালভার্ট-সেতুর পাশে নতুন সেতু-কালভার্ট নির্মাণকাজও প্রায় শেষ। ঈদে নতুন করে নির্মিত সড়ক ও সেতু ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে পারলে এই অংশে চাপ কিছুটা কমতে পারে বলে সওজের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
বঙ্গবন্ধু সেতু পার হয়ে মহাসড়কের সিরাজগঞ্জ অংশে গত মাসের শুরু থেকে মেরামত শুরু হয়। এর মধ্যে হাটিকুমরুল গোলচত্বর থেকে চান্দাইকোনা পর্যন্ত কিছু স্থানে সংস্কার না করেই কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া যেসব স্থানে সংস্কার করা হয়েছে, এক মাসের ব্যবধানে এরও স্থানে স্থানে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। মহাসড়কের বগুড়া অংশের ৬৫ কিলোমিটার অংশ সংস্কারে গত ১০ বছরে প্রায় ১০০ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। এরপরও এই অংশটুকু একেবারে নিখুঁত হয়নি কখনোই। বর্তমানে চান্দাইকোনা থেকে বগুড়ার বনানী মোড় পর্যন্ত ৭ কিলোমিটার অংশ খানাখন্দে ভরা। ইটের আধলা ফেলে জোড়াতালির মেরামত দিয়ে কাজ চালানো হচ্ছে।
ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের পাটুরিয়া ঘাট পর্যন্ত সড়কে কোনো খানাখন্দ নেই। তবে দৌলতদিয়া থেকে ফরিদপুর পর্যন্ত সড়কের বিভিন্ন স্থানে খানাখন্দ দেখা গেছে। এ ছাড়া ফেরিঘাটের কাছে দুই কিলোমিটার চার লেনের কাজ চলছে, কিন্তু কাজ এখনো শেষ হয়নি। এরপর যশোর অংশের ৬৪ কিলোমিটারের মধ্যে ৩৮ কিলোমিটারের অবস্থা এখনো নাজুক। দীর্ঘদিন জোড়াতালির মেরামত, পরক্ষণেই তা খানাখন্দে পরিণত হওয়া এবং পুনরায় সংস্কার—এই চক্রে চলছে।






মতামত দিন।

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*