প্রাণের ৭১

সম্পাদকীয়

উন্নয়নের সুফল সরকার ও জনগণের কাছে যাচ্ছে না – মোহাম্মদ হাসান

দারিদ্র্য বিমোচনে সরকারের সাফল্যগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, টেকসই সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর মাধ্যমে গ্রামীণ জনপদে সর্ব ক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ যার ফলশ্রুতিতে উল্লেখযোগ্য হারে দারিদ্র্যের হার কমে বর্তমান দাঁড়িয়েছে ২২.৩ শতাংশ আর চরম দারিদ্র্য নেমে এসেছে ১৩ শতাংশে। প্রবন্ধকার আরও উল্লেখ করেছেন যে রূপকল্প ২০২১ এবং জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এস.ডি.জি) অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে ঘোষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছে।

এই সব অর্জনের পরও দেখা যায় যে নৈতিক অর্থনীতির বিষয়টি এক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে অর্থাত্ নৈতিকতার ভিত্তিতে পরিচালিত অর্থনীতির সূচকগুলো অনেকাংশে ফলদায়ক হচ্ছে না— যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে ধনী-গরিবের বৈষম্যের মাধ্যমে। এর প্রমাণ পাওয়া যাবে সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখান ব্যুরো (বিবিএস) এর খানা আয় ও ব্যয় জরিপ ২০১৬ এর ফলাফলে। ফলাফলটি এ রকম যে জনগোষ্ঠীর নিচের পাঁচ শতাংশের আয় ক্রমাগত কমছে, স্ফীত হচ্ছে মধ্যবিত্ত আর উচ্চবিত্ত। যার ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুবিধা পাচ্ছে না দরিদ্র শ্রেণি।

প্রবন্ধকার আরও বলেছেন যে এই অবস্থার উন্নতিকল্পে যা করা প্রয়োজন তার মধ্যে রয়েছে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আয় বৃদ্ধি, সামাজিক সুরক্ষার পরিধি বাড়ানো, সর্বক্ষেত্রে সুশাসন তথা জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা, কর আদায়ের প্রসার, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের মাধ্যমে তরুণদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি, সেবা পেতে ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধ করা, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো ইত্যাদি। কিন্তু কীভাবে এই সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা হবে তার কোনো রোডম্যাপ তিনি দেননি।

এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলার সফলতার সঙ্গে টেকসই দারিদ্র্য বিমোচন কিংবা নিরসনের বিষয়টি সম্পর্কযুক্ত। কারণ পরিসংখ্যান বলছে, দেশে গড়ে দারিদ্র্য কমছে ১.৪ শতাংশ হারে, অপরদিকে জনসংখা বাড়ছে গড়ে ১.৬ শতাংশ হারে— যার সঙ্গে দারিদ্র্য বাড়া/কমার একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। তা ছাড়াও সাম্প্রতিককালে চাল, লবণ, পেঁয়াজ, ডালসহ ভোগ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির ফলে দেশের পাঁচ লাখ পরিবারের দারিদ্র্য বেড়েছে। পাশাপাশি গত বছরের মার্চ মাসে হাওর অঞ্চলের ৭টি জেলার বোরো ফসল সম্পূর্ণ নষ্ট হওয়ায়— বিশেষত সব ধরনের পরিবারে খাদ্য নিরাপত্তা, জীবন-জীবিকার নিরাপত্তা বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে যার সঙ্গে দারিদ্র্যের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। আবার দেশের পূর্বাঞ্চলে গত জুন-জুলাই মাসে উজান থেকে পানি প্রবাহ বিশেষত তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনার অববাহিকায় পানিপ্রবাহ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় উত্তরাঞ্চলের ৬টি জেলার কৃষি অর্থনীতি বিশেষত আমন ফসল, গবাদিপশু, মত্স্য সম্পদসহ বনসম্পদ নষ্ট হয়েছে যার বড় ভুক্তভোগী প্রান্তিক জনগোষ্ঠী যা দারিদ্র্য বৃদ্ধির প্রবণতাকে উত্সাহ জোগায়।

এখন আবার জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে শীতের তীব্রতা বেড়েছে অনেকাংশে যা দেশের এক-পঞ্চমাংশ বিশেষত সাড়ে তিন কোটি মানুষের স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণকে বাধাগ্রস্ত করছে। কাজেই সরকারি তথ্য ছাড়াও নিরপেক্ষ গবেষণা বলছে, দারিদ্র্য কমার বিষয়টি কোনো টেকসই ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারছে তা দাবি করা যায় না। আবার কেউ বলছেন মানবীয় দারিদ্র্য (Human Poverty) অনেকাংশে আয় দারিদ্র্যকে (Income Poverty) ছাড়িয়ে গেছে যার যথাযথ সমাধান জরুরি। বিশেষত নৈতিক অর্থনীতির (Elthical economics) দিক থেকে। প্রবন্ধকার নিজেও বলেছেন বা স্বীকার করেছেন ধনী-গরিবের বৈষম্য বেড়েছে, উচ্চ প্রবৃদ্ধি হলেও তার সুফল দরিদ্র শ্রেণি পাচ্ছে না, ন্যায্য বণ্টন হচ্ছে না। এই অবস্থায় বৈষম্য কমাতে দরিদ্র শ্রেণির আয় বাড়াতে হবে কীভাবে? সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে Trickle down effect এর প্রভাব এখনও রয়েছে।

বাংলাদেশে বর্তমানে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের আওতায় রয়েছে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬৬ শতাংশ যার সিংহভাগ হলো যুবক— যাদের বয়স ১৮-৪০ বছর। তাদের মধ্যে উচ্চশিক্ষিতের সংখ্যা (বিবিএ, এম.বি.এ ডিগ্রিধারী) অনেক—যারা কর্মসংস্থানের অপেক্ষায় দিন গুনছে। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সরকারি কিংবা বেসরকারি খাতে চাকুরির বাজার খুবই প্রতিযোগিতাপূর্ণ, আবার সুযোগ সংকীর্ণ। ফলে স্বনিয়োজিত কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রটি খোলা আছে তাদের জন্য যারা উদ্যোগকে পেশা হিসাবে বেছে নিতে চায়। কিন্তু পরিবেশ সহায়ক কি? যদি না থাকে তবে তৈরি করতে হবে। এর জন্য সরকারের নির্দেশনায় সরকারি/বেসরকারি অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সহজ শর্তে তহবিল জোগানোর ব্যবস্থা করবে। কমাতে হবে প্রশাসনিক জটিলতা। পাশাপাশি বাড়াতে হবে উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ—বিশেষত উত্পাদনভিত্তিক কর্মসূচিতে। সুশাসন উন্নয়নের পূর্বশর্ত এবং এই উন্নয়নের ফসল জনগণের ঘরে উঠবে যদি ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধ হয়। কিন্তু প্রশ্নটা হলো কীভাবে?

এখানেই আসে নৈতিকতার প্রশ্ন। কারণ স্বশাসন, গুরুর শাসন, পিতা-মাতার শাসন সবগুলোই শাসনের বিভিন্ন পর্যায় কিন্তু প্রশাসনের শাসন যার মধ্যে নির্বাহী বিভাগের শাসন ও আইনের শাসন আমাদের কর্মজীবনে বেশি প্রভাব ফেলছে। বিশেষত সেবা খাতে সেটা শিক্ষা, স্বাস্থ্য কিংবা যোগাযোগ যাই হোক না কেন। এই খাতগুলো সব সময় আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে থাকছে। কিন্তু কোনো সহজ সমাধান খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। উন্নয়নের সুফল সরকার কিংবা জনগণ কারো কাছে যাচ্ছে না বরং চলে যাচ্ছে দুর্নীতি খাতে যা খুবই শক্তিশালী একটি বলয়।

২০১৭ সালের হিসাবে দেখা গেছে, জুলাই ডিসেম্বর পর্যন্ত কর প্রদানের সময় বদ্ধি, দেশ জুড়ে কর মেলার আয়োজন ইত্যাদির ফলে টিনধারী গ্রাহকের সংখ্যা গত ১৯১৬ সালের তুলনায় কিছু বেড়ে দাঁড়িয়েছে সরকারি হিসাবমতে ৩৩ লক্ষ কিন্তু আয়কর রিটার্ন জমা দিয়েছে তার অর্ধেক এবং সরকার এন.বি.আর. আইনে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নিচ্ছে না। ফলে সরকার প্রতিবছরই তার আয়করের টার্গেট অর্জন করতে অপারগ হচ্ছে হারাচ্ছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় যা দিয়ে সরকার ব্যয়ের খাতে আরও ভূমিকা পালন করতে পারত। এছাড়াও আর্থিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি খাতের অব্যবস্থা নিরসনে এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সরকার যদি কার্যকর পদক্ষেপ না নেয় তাহলে দেশের একটি বড় অংশ ক্রমাগতভাবে তাদের নিজের অবস্থান থেকে সরে নিম্নমুখে ধাবিত হবে।

এরজন্য প্রথম প্রয়োজন আইনের সফল প্রয়োগ। এর বাস্তবায়ন হলে মানুষ আইনের পথে চলবে আর আইন অমান্যকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া গেলে সমাজ এর থেকে অনেক শিক্ষা গ্রহণ করবে; ২) নৈতিক শিক্ষার প্রসার বা নৈতিক আচরণের দীক্ষা কেবল সরকারপ্রধানকে মানলেই চলবে না তার অনুসারীদেরও এতে আকৃষ্ট হওয়ার জাদু সৃষ্টি করতে হবে; ৩) দেশে কাজের কৃষ্টি সৃষ্টি করতে হবে অর্থনৈতিকভাবে যা হবে উত্পাদনমুখী, কর্মসৃজনমুখী, পরিবেশবান্ধব, আদর্শিক ও রপ্তানিমুখী। এখানে জাতি, ধর্ম, রাজনৈতিক মতাদর্শ নির্বিশেষে সবার সমান প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হবে উন্নয়নের স্বার্থে; ৪) গণতন্ত্র উন্নয়নের পূর্ব শর্ত এবং উন্নয়ন টেকসই করতে হলে গণতন্ত্র চর্চা অর্থাত্ মূল্যবোধ চর্চা অবশ্যই শক্ত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করতে হবে; ৫) মুক্তিযুদ্ধ আমাদেরকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র উপহার দিয়েছে চারটি মূলনীতির ভিত্তিতে যেমন গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও জাতীয়তাবাদ।

বর্তমান সরকার এই চেতনায় বিশ্বাসী কিন্তু সমাজের সকল স্তরে এইগুলো প্রতিষ্ঠা করা সরকারের নৈতিক দায়িত্ব বলে প্রতীয়মান। কিন্তু এ জায়গাটিতে দেশের সাফল্য ম্লান হয় বার বার। দেশে-বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়। এতে দরিদ্র শ্রেণির লোকজন বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলায় রাজনীতিতে নৈতিক বোধের চর্চা আরো বাড়ানো প্রয়োজন; ৬) ২০২১ সালের মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর বাংলাদেশকে মধ্য আয়ের দেশে উন্নীতকরণ এবং দারিদ্র্যের হার ১৩.৫ শতাংশ নামিয়ে আনার লক্ষ্য অর্জন করতে হলে আলোচিত চ্যালেঞ্জগুলো সাফল্যের সঙ্গে মোকাবেলা করতে হবে। তাহলেই অর্জিত সাফল্য অর্থবহ হবে। আবার এস.ডি.জি মতে ২০৩০ সালের মধ্যে অতি দারিদ্র্যের হার ৩ শতাংশে নামানোরও কথা রয়েছে এবং জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি ৮.৫ শতাংশ অর্জন করতে হবে। সরকারের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে যদি নৈতিকতার সঙ্গে সরকারি-বেসরকারি কাঠামোতে কর্ম সম্পাদন হয় তবে অবশ্যই এ অর্জন সম্ভব। ★সূত্রঃ মিহির রায়, অর্থনীতিবিদ এর প্রকাশিত প্রতিবেদন।

লেখকঃ মোহাম্মদ হাসান, সাংবাদিক, কলামিস্ট।



(পরবর্তি সংবাদ) »



মতামত দিন।

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*