প্রাণের ৭১

একাত্তরের এই দিনেঃ ১৯ মার্চ: মোহাম্মদ হাসান

উত্তাল ১৯ মার্চ ১৯৭১ঃ গাজীপুরের জয়দেবপুরে সংঘটিত হয় প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধ। মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা এক গৌরবদীপ্ত অধ্যায়।একাত্তরের ২৬শে মার্চ থেকে আমাদের চূড়ান্ত স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলেও এর পূর্বে ১৯ মার্চ জয়দেবপুরের মাটিতেই সূচিত হয়েছিল বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্বে বীর বাঙালির প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ।

এ দিনেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিকামী বাঙালির পক্ষ থেকে গর্জে উঠেছিল বন্দুক। আর সে কারণেই একাত্তরের মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে সমগ্র বাংলাদেশে স্লোগান উঠেছিল “জয়দেবপুরের পথ ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর” ।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর এর তথ্য মতে,অসহযোগ আন্দোলনের ১৯ দিবসে ঢাকার অদূরস্থ জয়দেবপুরে জনতা এবং সেনাবাহিনীর সদস্যদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। সংঘর্ষে ৫০ জন শহীদ হন এবং প্রায় দুই শতাধিক আহত হন। সন্ধ্যায় জয়দেবপুর শহরে অনির্দিষ্টকালের জন্য সান্ধ্য আইন জারি করা হয়।
জয়দেবপুরে নিরস্ত্র নাগরিকদের ওপর সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণের তীব্র নিন্দা জানিয়ে সন্ধ্যায় শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, যাঁরা বুলেট ও শক্তি দিয়ে গণ আন্দোলনকে স্তব্ধ করবেন বলে ভেবেছেন তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। বাংলাদেশের মানুষ সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান চায়। কিন্তু এর অর্থ এই নয়, তারা শক্তি প্রয়োগে ভয় পায়।

জয়দেবপুরে নিরস্ত্র মানুষের ওপর গুলিবর্ষণ এবং হত্যার সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে রাজধানী ঢাকা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। হাজার হাজার মানুষ লাঠি-সোটা, বর্শা-বল্লম নিয়ে রাজপথে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।

একদিন বিরতির পর সকালে আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের মধ্যে তৃতীয় দফা একান্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। দেড়ঘন্টা ব্যাপী ঐ বৈঠকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে কোনো সহকারী উপস্থিত ছিলেন না।
আজও রাজধানী ঢাকা-সহ সারা দেশে সরকারি-বেসরকারি ভবন ও বাসভবনে কালোপতাকা উত্তোলন করা হয়। সরকারি-আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মবিরতি চলে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। ছাত্র-ছাত্রী ও তরুন-তরুনীদের কুজকাওয়াজ ও অস্ত্র চালন প্রশিক্ষণ চলে।

সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ভবনে উপদেষ্টা পর‌্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। দুইঘন্টা স্থায়ী এই বৈঠকে আওয়ামী লীগের পক্ষে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, ড.কামাল হোসেন এবং সরকারের পক্ষে বিচারপতি এ.আর কর্নেলিয়াস, জেনারেল পীরজাদা ও কর্নেল হাসান অংশ নেন।

ন্যাপ প্রধান মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী চট্টগ্রামে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া অহেতুক ঢাকায় এসে সময় নষ্ট করছেন। ইয়াহিয়া খানের বোঝা উচিত শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর ছাড়া পাকিস্তানকে রক্ষা করা সম্ভব নয়। তিনি আরো বলেন, জেনারেল ইয়াহিয়া খানের মনে রাখা উচিত যে, তিনি জনগণের প্রতিনিধি নন। সুতরাং জনগণের ওপর কর্তৃত্ব করার কোনো অধিকার তার নেই।

করাচীতে জাতীয় পরিসদের স্বতন্ত্র সদস্য-সহ সংখ্যালঘিষ্ঠ দলসমূহের পার্লামেন্টারী পার্টির নেতারা এক বৈঠকে মিলিত হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে ভূট্টো বিরোধী একটি যুক্তফ্রন্ট গঠনের সিদ্ধান্ত নেন।
পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভূট্টো পশ্চিম পাকিস্তানে একটি গণ আন্দোলন শুরুর লক্ষ্যে তাঁর দলের প্রস্তুতি গ্রহনের কথা ঘোষণা করে সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন- ক্ষমতার ব্যাপারে পিপলস পার্টিকে হিস্যা থেকে বঞ্চিত করার ষড়যন্ত্র করা হলে আমি চুপ করে বসে থাকবো না। তিনি সাংবাদিকদের আরো বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের লোকদের শক্তি দেখেছেন, এবার আপনারা পশ্চিম পাকিস্তানীদের শক্তি দেখতে পাবেন।

তথ্যসূত্র : মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর।
লেখকঃ মোহাম্মদ হাসান, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।






মতামত দিন।

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*