প্রাণের ৭১

করোনা শিশুদের জন্য যেন ‘মরার উপর খরার ঘা’- মোহাম্মদ হাসান

শতাব্দীর ভয়াবহ বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ঝুঁকি মহামারি করোনা সংকটময় সময়ে স্বাভাবিক ছন্দময় জীবনের ছন্দপতন শুরু হয়েছে । বিশেষ করে শিশু ও শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এর ব্যাপক প্রভাব পরেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছুটি ঘোষণা দেওয়ার পর প্রথম প্রথম বিষয়টা হয়ত শিক্ষার্থীদের জন্য বেশ আনন্দের ছিল। তবে দিন গড়ানোর পাশাপাশি আনন্দের জায়গা দখল করে নিয়েছে বিষন্নতা ও অস্থিরতা।

অনেক শিক্ষার্থী এখন বই নিয়ে আগের মত পড়তেও বসছে না। তাদের মধ্যে ধারণা কাজ করছে। স্কুল বন্ধ পড়তে হবে কেন। আগে যেমন তাদের কিছু ছক বাঁধা নিয়ম ছিলো। সকাল থেকে স্কুল, প্রাইভেট, সঙ্গীদের সাথে খেলাধূলা, খুনসূটি অতপর রাতের পড়া আহার নিদ্রা। দীর্ঘদিন এ নিয়মে বাধ সেঁধেছে করোনা মহামারি। বড়দের মত তারাও টিভি, মোবাইল, ইন্টারনেটে সময় কাটাতে গিয়ে অনেক তথ্য বুঝতে পারছে না। ফলে উদ্বেগ বেড়ে যাচ্ছে ওদের। সাথে আতঙ্কও। তাই মা–বাবা অথবা পরিবারের অন্য বয়স্ক মানুষ বয়স উপযোগী এবং সহায়ক মনোভাব নিয়ে বিষয়গুলো আলোচনা করলে তাদের বুঝতে সহজ হবে এবং উদ্বেগের মাত্রা অনেক কমে যাবে।

শিশুদের মধ্যে প্রধানত দুশ্চিন্তা, বিষণ্নতাসহ বিভিন্ন আচরণগত সমস্যা হয়। শিশুরা তাদের উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা, উৎকণ্ঠা বড়দের মতো করে প্রকাশ করতে পারে না। ফলে সহজেই অস্থিরতা, রাগ, বিরক্তি, ভয় পাওয়া, খাওয়া ও ঘুমের সমস্যা ইত্যাদি শিশুদের মধ্যে দেখা যায়। তার উপর এ করোনা যেন তাদের জন্য ‘মরার উপর খরার ঘা’ এর মতো হয়েছে। ফলে শিশুদের অস্থিরতা, রাগ, বিরক্তি, ভয় পাওয়া, খাওয়া ও ঘুমের সমস্যা আরও অতিমাত্রায় দেখে দিয়েছে।

ইতিমধ্যে বৈশ্বিক মহামারি করোনার এ কঠিন সময়ে বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আমরা শিশু থেকে বৃদ্ধ, সব বয়সী মানুষই এই মরণঘাতী করোনাকে সঙ্গী করে নিয়ে চলতে শুরু করেছি। যার প্রভাব পড়ছে আমাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর। পরিবর্তন ঘটছে আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায়। বড়রা নিজেদের পরিবর্তনগুলো বুঝতে পারলেও শিশুরা খাপ খাওয়াতে পারছে না মোটেই। আর আমরা বড়রারও হয়তো ঠিকমতো শিশুর এ সমস্যার বিষয়ে ভাবিনি বা ভাবছিনা। অনেকে বুঝতেছিও না।

যে শিশু বা শিক্ষার্থীটি আগে তিনদিন স্কুল বন্ধ পেলে মায়ের কাছে বায়না ধরে পাশের গাঁয়ের খালা- মাসীর বাড়ি বেড়াতে যাওয়ার অনুমতি পেতো। সে আবার গেলো ৯/১০ মাসের বন্ধ পেয়েও বেরুতি পারেনি বাড়ির আঙ্গিনা থেকে। এতেকরে তার সে বয়সের উপলব্ধি তাকে আতঙ্কিত করে তুলছে। তাছাড়া যেমন পাশের ঘরের বড় আপুর বিয়ে হয়েছিল দুই বছর আগে মহা ধুমধামে, সকল আত্মীয় এসেছিলো বাড়িতে, গায়ে হলুদ রাতে চলছে প্যাকেজ পোগ্রাম সাথে বিরানিও। আর গত মাসে ছোট আপুর বিয়ে হলো গোটা ৩০ এক মানুষ আসলো অল্প সংখ্যক আত্মীয় এসেছিল। প্যাকেজ বা সাউন্ড বাক্স বাজেনি এসব দেখে শিশুদের মধ্যে সুপ্ত আতঙ্ক আরও প্রবল হয়। এক্ষেত্রে আমরাও বড়রাও শিশুদের সাথে গল্পের ছলেও বলা হয়নি করোনা মোকাবিলায় সাময়িক এ ছন্দ পতনের বিষয়টি। আর শিশুরাতো প্রকাশ করবেনা বরং সে আরও এজাতীয় বিষয়গুলো অনুসন্ধানী চোখে দেখবে ও ভাববে।

ইউনিসেফ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভাষ্যমতে, শিশুদের কোভিড–১৯–এর সংক্ষিপ্ত নির্দেশিকার আলোকে দেখা যায়:

১. শিশুকে খোলাখুলি প্রশ্ন করে জানুন সে কোভিড–১৯ সম্পর্কে কতটুকু জানে।

২. সৎ থাকুন। বিষয়টি শিশুবান্ধব উপায়ে ব্যাখ্যা করুন। তাদের প্রতিক্রিয়া খেয়াল করুন এবং উদ্বেগের মাত্রা বোঝার চেষ্টা করুন এবং তাদের প্রতি সংবেদনশীল হোন। কোনো কিছু বানিয়ে বলবেন না। তাদের জানান, মিডিয়ার সব তথ্য সঠিক নয়, বিশেষজ্ঞের মতামত জানা প্রয়োজন।

৩. ছেলেমেয়েরা কীভাবে নিজেদের এবং তাদের বন্ধুদের রক্ষা করতে পারে, তা দেখিয়ে দিন। হাত ধোয়া, হাঁচি–কাশির সময় কীভাবে কনুই দিয়ে নাক–মুখ ঢাকতে হবে তা দেখিয়ে দিন। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, যাদের উপসর্গ আছে তাদের কাছে না যাওয়া এবং জ্বর, কাশি ও শ্বাসকষ্ট হলে সঙ্গে সঙ্গে জানাতে বলুন।

৪. আশ্বস্ত করুন। টিভি বা অনলাইনে মন খারাপ করা ছবি দেখে বাচ্চারা খুব ভয় পেতে পারে, তখন বাচ্চাকে নিয়ে খেলাধুলা করে শান্ত করার চেষ্টা করুন। বলুন, তাকে সুস্থ রাখার জন্য বড়রা কাজ করছে। শিশুকে বোঝান সে অসুস্থ হলে তাকে ঘরে বা হাসপাতালে থাকতে হবে নিজের এবং অন্যদের ভালোর জন্য, যদিও তা বোরিং।

৫. দেখুন শিশুরা কোনো স্টিগমার শিকার হচ্ছে কি না। শিশুকে জানান যে কোভিড–১৯ জাতিধর্মবর্ণ–নির্বিশেষে যে কারও হতে পারে। দুষ্টুমির ছলে মশকরা অথবা কোনো হুমকির শিকার হলে সে যেন অভিভাবককে জানায়।

৬. সাহায্যকারীদের দিকে নজর দিন। সম্মুখযোদ্ধাদের কথা শিশুদের বলুন। সহৃদয় লোকজন পাশে আছেন জানলে ওরা স্বস্তি পাবে।

৭. নিজের প্রতি যত্নশীল হোন। বাচ্চারা বড়দের ব্যবহার খেয়াল করে। তাই নিজেদর মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিন। কোনো সংবাদে উৎকণ্ঠা হলে কারও সঙ্গে শেয়ার করুন, সময় নিন। বাচ্চাকে বুঝতে দিন আপনি ঠিক আছেন।

৮. সতর্কতার সঙ্গে আলোচনা শেষ করুন। আলোচনা শেষ করার সময় বাচ্চার উদ্বেগের মাত্রা বোঝার চেষ্টা করুন বাচ্চার শরীরী ভাষা, কথা বলার ধরন এবং শ্বাস–প্রশ্বাসের স্বাভাবিকতা দেখে।

একটা বিষয় মনে রাখতে হবে যে, আতঙ্কিত ও উদ্বিগ্ন শিশুরা বাবা–মায়ের কাছে ঘেঁষে থাকতে চায় এবং বেশি আবদার করে। মা–বাবা যেন ধৈর্যসহকারে বাচ্চার কথা শোনেন এবং বাচ্চার জায়গা থেকে বিষয়টি চিন্তা করে তাকে বুঝিয়ে দেন।

শিশু যদি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে যায়, তাহলে দেরি না করে অনলাইনে বা সরাসরি চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

শিশুকে যথেষ্ট সময় দিন। শিশুর কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন এবং তার মনোভাব প্রকাশ করার সুযোগ দিন। শিশুর বয়স অনুযায়ী গল্প, ছবি আঁকা, খেলাধুলো বা স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিকটতম কোন বিনোদন কেন্দ্র, দর্শনীয় স্থানে নিয়ে ঘুরিয়ে আনুন। শিশুকে মা–বাবা এবং পরিবারের সদস্যদের কাছাকাছি রাখুন, পরিবারের নিয়মিত রুটিন বজায় রাখুন।

তবে বর্তমান সময়ে কিছুটা শিথিলতার সঙ্গে শিশুদের পড়াশোনার রুটিন করা, বয়স উপযোগী বাসার কাজে সাহায্য করা, খেলাধুলা করা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করাই শ্রেয়।

লেখকঃ মোহাম্মদ হাসান, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।






মতামত দিন।

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*