নয়া পল্টনের সন্ত্রাস শেষ সন্ত্রাস নয়।।
 
            
                     
                        
       		আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী।।
ঢাকার একটি দৈনিকের সম্পাদকীয় বিভাগের এক বন্ধুর সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ হচ্ছিল। তার কাগজে আমি কলাম লিখি। কথায় কথায় তিনি বললেন, ‘আপনি কেবল ড. কামাল হোসেনের মন্দ দিকের সমালোচনা করেন। কিন্তু তার একটি ভালো দিকও আছে। তার এই ভালো দিকেরও স্বীকৃতি দেওয়া উচিত।’ তাকে জিজ্ঞেস করেছি, ড. কামালের এই ভালো দিকটি কী? সাংবাদিক বন্ধু বললেন, এ কথা তো স্বীকার করবেন, বিএনপি এবারও নির্বাচনে আসত না। ড. কামাল হোসেনই তাদের নির্বাচনে নিয়ে এসেছেন। এটা দেশের জন্য মন্দ হয়েছে না ভালো হয়েছে, তা বলুন!
বলেছি, অবশ্যই ভালো হয়েছে। এ জন্য তাকে একটা ধন্যবাদ জানাব, ভেবেছিলাম। কিন্তু তিনি যদি বিএনপি জোটের নেতৃত্ব নিয়ে জোটটিকে তার নির্দেশমতো চালাতে পারতেন, তাহলে তাকে জোর অভিনন্দন জানাতাম। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, তিনি নিজেই তারেক রহমানের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছেন। তারেকের নির্দেশ মেনে কাজ করছেন। এদিক থেকে বলতে গেলে ড. কামাল হোসেন যেমন বিএনপিকে বাঁচিয়েছেন, তেমনি বিএনপিও তাকে বাঁচিয়েছে। এটা ম্যারেজ অব কনভিনিয়েন্স।
সাংবাদিক বন্ধুর সঙ্গে আর আলোচনা এগোয়নি। তাই এই লেখাতেই নিজের কথায় বিশ্নেষণ করছি। ক’দিন আগেও নেতৃত্বহীন বিএনপি নির্বাচনে যোগ দেবে কি, তাদের মধ্যে ভাঙনের সুর বেজে উঠেছিল। বিএনপি ঘরানার সম্পূর্ণ বাইরে থেকে এসে ড. কামাল হোসেন সেই নেতৃত্বের শূন্যতা পূরণ করে ও জোটে খালেদা-তারেক নেতৃত্বের প্রতিনিধিত্ব করার দায়িত্ব গ্রহণপূর্বক দল এবং দলের দুই নেতাকে বাঁচিয়েছেন। অন্যদিকে বিএনপির সুবাদে তিনি রাজনীতিতে ফসিল থেকে আবার ফসল হয়ে উঠেছেন। তার সারা রাজনৈতিক জীবনে তিনি আর কখনও মিডিয়ায় বা রাজনৈতিক আড্ডায় এতটা আলোচিত হয়েছেন বা গুরুত্ব পেয়েছেন, তা আমার মনে হয় না।
কিন্তু এই ফসল তিনি বেশিদিন ধরে রাখতে পারবেন কি? বিএনপি জোট বা ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্ব গ্রহণ করে তিনি এই জোটে তার নেতৃত্ব ও ব্যক্তিত্বের ছাপ ((Stump of his personality and leadership)
ফেলতে পারেননি। পারলে ভালো হতো। ঐক্যফ্রন্টে তার নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে (ডা. বদরুদ্দোজাকে সরিয়ে দিয়ে) বর্তমানে কারাবন্দি ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন এই আশাই ব্যক্ত করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘বিএনপি নেতৃত্ব থেকে তারেক রহমানকে সরানোর জন্য ড. কামালকে নেতৃত্বে এনেছি।’ তার এই আশাবাদ সত্য হয়নি। বিএনপি জোট বা ঐক্যফ্রন্টের প্রকৃত নেতা হওয়ার বদলে তিনি তারেক ও বিএনপির হাতে শিখণ্ডী হয়ে গেছেন।
ড. কামাল যদি তা না হতেন, তাহলে নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের তফসিল ও তারিখ ঐক্যফ্রন্টের অনুরোধমতো সাত দিন পিছিয়ে দেওয়ার পরও বিএনপির দাবি মোতাবেক আরও পিছিয়ে দেওয়ার জন্য প্রতিনিধি দলসহ সিইসির কাছে যেতেন না এবং তার সঙ্গে অসহিষ্ণু ও অসৌজন্যমূলক আচরণ করতেন না। গত বুধবার নয়াপল্টনে বিএনপি অফিস থেকে নমিনেশন পেপার সংগ্রহের নামে যানজট তৈরি করে জোটের একদল নেতাকর্মী ও সমর্থক যাতে পুলিশের সঙ্গে রায়ট না বাধায় এবং আবার রাস্তায় গাড়িগোড়ায় আগুন দেওয়ার পুরনো সন্ত্রাস শুরু না করে, সে জন্য তার প্রভাব খাটাতেন। নিদেনপক্ষে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে যাতে নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করা না হয়, সে জন্য জোটকে সাবধান করতেন। কিন্তু এই দাঙ্গা-হাঙ্গামা সম্পর্কে বিএনপি নেতারা সরকারের ওপর সব দোষ চাপাচ্ছেন; কিন্তু ড. কামালের মুখে রা-টি নেই।
সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনায় আওয়ামী লীগ সরকার যেখানে স্বস্তিবচন আওড়াচ্ছে এবং নিজেদের ঘর গোছাতে চাচ্ছে, সেখানে অহেতুক বিএনপি অফিসের সামনে পুলিশি হামলা চালাতে যাবে কেন? আর এই হামলা পুলিশ পরিকল্পিতভাবে করতে চাইলে বিএনপির নেতাকর্মী ও সমর্থকরা কি পুলিশকে আহত করার এবং তাদের একাধিক গাড়ি পোড়ানোর সুযোগ পেত?
বরং গোটা ঘটনাটিই যে বিএনপির পূর্বপরিকল্পিত, তার আভাস পাওয়া যায় মিডিয়ায় প্রকাশিত খবরেই। এই খবরে জানা যায়, বিএনপির দুই প্রভাবশালী নেতা মির্জা আব্বাস ও রিজভী প্রকাশ্যেই বলেছেন, তারা হাসিনা সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে খুশি নন। প্রকাশিত খবরেই দেখা যায়, মির্জা আব্বাসের কর্মী ও সমর্থকরাই নয়াপল্টনে গিয়ে ট্রাফিক জ্যাম তৈরি করে এই গণ্ডগোলের সূত্রপাত করেছিল। নির্বাচন বানচাল করাই কি উদ্দেশ্য ছিল?
বুধবারের এই দাঙ্গার পাশাপাশি আমার সহৃদয় পাঠকরা যদি সেদিনের আকস্মিক দাঙ্গার তাৎপর্যটি উপলব্ধি করেন, তাহলে তাদের কাছে আরও স্পষ্ট হবে। তারেক একদিকে তার জোটকে নির্দেশ দিচ্ছেন নির্বাচনে যাওয়ার জন্য; অন্যদিকে হুঙ্কার দিয়ে বলেছেন, ‘নির্বাচনের দিন প্রতিটি ভোটকেন্দ্র রণক্ষেত্রে পরিণত হবে।’ ড. কামাল হোসেন কি পারবেন, তারেক রহমানের এই অপরাজনীতি এবং লন্ডন ষড়যন্ত্র থেকে ঐক্যফ্রন্টকে রক্ষা করতে?
বিএনপি সরকারের আমলে কী দেখা গেছে? খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের পাশাপাশি আরও বেশি শক্তিশালী দ্বিতীয় ক্ষমতার কেন্দ্র গড়ে উঠেছে হাওয়া ভবনে। তার অধীশ্বর তারেক রহমান। মূলত তার নির্দেশে দল এবং সরকার চলত। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি কি ঐক্যফ্রন্টের রাজনীতির বেলায় ঘটবে? ড. কামাল হোসেন ভারতের মতো সিংহাসনের রামের পাদুকা রেখে রাজা সাজার অনুকরণে ঐক্যফ্রন্টের নেতা থাকবেন, নাকি সাহসের সঙ্গে ঐক্যফ্রন্টের প্রকৃত নেতা হতে পারবেন? যদি পারতেন, তাহলে নির্বাচনের তারিখ আরেক দফা বাড়ানোর আবদার নিয়ে নির্বাচন কমিশনের দ্বারস্থ হতেন না এবং বুধবারের সন্ত্রাসও ঘটত না।
তবে বুধবারের এই ঘটনাটি বিএনপি জোটের জন্য বুমেরাং হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় এই সম্পর্কে সব পেশার মানুষের যে অভিমত ব্যক্ত হয়েছে, তা আমার এই মন্তব্যকেই সঠিক প্রমাণ করে। এই অভিমত বা জনমত হচ্ছে, ‘বুধবারে নয়াপল্টনের সন্ত্রাস দ্বারা প্রমাণ করা হয়েছে, বিএনপি একটি সন্ত্রাসী দল। রাস্তার মানুষকে নির্যাতন এবং গাড়ি ও দোকানপাটে আগুন দেওয়া ছাড়া তারা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করতে জানে না অথবা চায় না। অথচ তারা দাবি করে, সরকার তাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনেও বাধা দেয়। বাধা না দিলে তারা যে শান্তি ও জননিরাপত্তা দুই-ই বিপন্ন করে, সরকারের এই কৈফিয়ত গত বুধবার সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছে।
আমার একটি আশঙ্কা, বুধবারের সন্ত্রাসই নির্বাচনপূর্ব শেষ সন্ত্রাস নয়। তারেক রহমান হুমকি দিয়েছেন, নির্বাচনের দিন প্রতিটি ভোটকেন্দ্র তিনি রণক্ষেত্রে পরিণত করবেন। এটা হয়তো অসার হুমকি; কিন্তু নির্বাচনী প্রচারে বিএনপি জোট সুযোগমতো ছোট-বড় হাঙ্গামা যে বাধাবে, তাতে সন্দেহ নেই। এর উদ্দেশ্য হবে, নির্বাচনে শান্তি বজায় থাকছে না। সুতরাং সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসির ক্ষমতা দিয়ে নিয়োগ করা প্রয়োজন, তাদের এই দাবিটিকে সঠিক প্রমাণ করে সরকারকে সেনা মোতায়েনে বাধ্য করা। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য, নির্বাচনে পরাজয় হবে এই আভাস পেলে আরও বড় গোলযোগ সৃষ্টি করে নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করা। নির্বাচনের আগে কিছু খুনখারাবি হলেও বিস্মিত হবো না। ‘নির্বাচনের দিন প্রতিটি ভোটকেন্দ্র রণক্ষেত্র হবে’ এই হুমকি খুব তাৎপর্যহীন নয়।
আমার আরেকটি অনুমান যে সঠিক হয়েছে, সেদিকেও সহৃদয় পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করি। কথাটা আরও কেউ কেউ বলেছেন; কিন্তু আমি জোরের সঙ্গে বলে আসছি, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট আসনে বিএনপি-জামায়াত জোটের নতুন খোলস এবং ড. কামাল হোসেন এই জোটের অস্থায়ী নেতা। প্রয়োজন ফুরালেই তিনি ব্যবহূত কমলার খোসায় পরিণত হবেন। আমাদের অনেকেই এই অনুমানটি যে ভুল নয়, তার প্রমাণ বিএনপির যে নতুন মিত্ররা জোটে এসেছেন, যেমন- আ স ম আবদুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্না এবং আমাদের ‘ভঙ্গবীর’- সকলেই বিএনপির ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। নির্বাচনে ঐক্যফ্রন্ট জয়ী হলে তা যে বিএনপির জয় বলেই ঘোষিত হবে এবং তাদের সরকারের প্রথম কাজ হবে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের দণ্ড মওকুফ করে তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনা, এ সম্পর্কে আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই। তা যদি হয় তাহলে ড. কামাল হোসেন একটি কৃতিত্ব অবশ্যই দাবি করতে পারবেন এবং তা হবে, দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা নয়, তারেকের স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সহজ করে দেওয়া। ‘কামাল তুনে কামাল কিয়া ভাই’।
বাংলাদেশ এবং বাঙালির জীবনে এই অভিশাপ যেন নেমে না আসে, সে জন্য আওয়ামী লীগকে অবশ্যই কঠোর ও সতর্ক হতে হবে। এই অভিশাপ ঠেকানোর বড় দায়িত্বটাই আওয়ামী লীগের। নির্বাচনে আওয়ামী মহাজোটের শরিক দলগুলোর মধ্যে আসন বণ্টন ও প্রার্থী মনোনয়নে যেন কোনোভাবেই জোটের ঐক্যে চিড় না ধরে। ইতিমধ্যেই ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা রাশেদ খান মেনন কিছুটা উষ্ফ্মা প্রকাশ করেছেন; সম্ভবত আসন বণ্টন সম্পকে। শেখ হাসিনাকেই এগিয়ে এসে জোটের সব অভ্যন্তরীণ বিবাদ ও মনোমালিন্য মেটাতে হবে। এই নির্বাচনযুদ্ধকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে যুদ্ধে কঠোর সৈনাপত্যের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে শেখ হাসিনাকেই। তাকে মনে রাখতে হবে, জাতীয় রাজনীতির বর্তমান অন্ধকার আকাশে তিনিই একমাত্র ধ্রুবতারা।

 
	