প্রাণের ৭১

‘প্রতিবাদী কলম’ বন্ধ করতে একের পর এক ব্লগার হত্যা বাংলাদেশে

‘প্রতিবাদী কলম’ বন্ধ করতে একের পর এক হত্যা চলছে বাংলাদেশে৷ সোমবার ফের মৌলবাদের শিকার শাহজাহান বাচ্চু৷ আগের সব হত্যাকান্ডের বিচার এখনও শেষ হয় নি৷ বাংলাদেশ সরকারের উদাসীনতায় প্রতিবাদী লেখককে চিরকালের জন্য চুপ করিয়ে দেবার ঘটনা বাড়ছে৷

বাংলাদেশে ২০১৩ সাল থেকে এই ব্লগার হত্যার শুরু৷ এখন পর্যন্ত বেশ কয়েকজন ব্লগারকে তাদের লেখালেখির কারণে হত্যা করা হলেও একটি বাদে কোনও মামলারই চোখে পড়ার মতো অগ্রগতি নেই। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ব্লগার আহমেদ রাজিব হায়দারকে হত্যা করা হয়৷

সেই শুরু৷ তারপর একের পর এক ‘মলমহীন কলম’ কে হত্যা করেছে উগ্র মৌলবাদীর দল৷ আহমেদ রাজিব হায়দার, অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান, নিলাদ্রী চট্টোপাধ্যায়, হূমায়ুন আজাদ, আরেফিন দীপন, নাজিমুদ্দিন সামাদ আরও অনেকে মৌলবাদীদের হাতে খুন হয়েছেন। সংখ্যাটা প্রতিবছর বাড়ছে।

২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যখন যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ বিচার ফাঁসীর দাবীতে উত্তাল শাহবাগের আন্দোলন, তখন ১৫ই ফেব্রুয়ারি এই শাহবাগ আন্দোলনেরই এক কর্মী আহমেদ রাজিব হায়দার দুর্বৃত্তদের চপারের আঘাতে নিহত হন। পরে প্রচার করা হয় ‘থাবা বাবা’ নামে পরিচিত হায়দার ছিলেন একজন নাস্তিক এবং তিনি ইসলাম ও এই ধর্মের নবী মহম্মদ সম্পর্কে কুরুচিপূর্ণ ব্লগ লিখতেন।

এই হত্যাকাণ্ডটিই ছিল ব্লগে লেখালেখির অপরাধে বাংলাদেশে প্রথম কোনও হত্যাকাণ্ড। এই ঘটনায় সন্দেহের ভিত্তিতে সাতজনকে আটক করে পুলিশ এবং তদন্ত শেষে হত্যাকাণ্ডের এগারো মাস পর আদালতে অভিযোগ পত্র দায়ের করা হয়।

অভিজিৎ রায় ছিলেন একজন মার্কিন প্রবাসী বাংলাদেশী। তিনি মুক্তমনা নামে একটি ব্লগ সাইটের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন যেখানে বিজ্ঞান বিষয়ক নানা লেখালেখি করা হত। ২০১৩ র ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি বাংলাদেশে আসেন৷ ২০১৫ র ২৬শে ফেব্রুয়ারি স্ত্রীকে নিয়ে বাংলা একাডেমির বইমেলা দেখে ফেরার পথে দুষ্কৃতিদের আক্রমণের মুখে পড়েন। হামলায় অভিজিৎ প্রাণ হারান। তার স্ত্রী রাফিদা বন্যা আহমেদও মারাত্মক আহত হন। এই ঘটনায় জড়িত সন্দেহে শফিউর রহমান ফারাবী নামে এক ব্যক্তিকে আটক করে পুলিশ।

অভিজিৎ রায়কে হত্যার এক মাসেরও কম সময়ের মাথায় ৩০ শে মার্চ ব্লগার ওয়াশিকুর রহমানকে ঢাকার তেজগাঁও এলাকায় প্রকাশ্য রাস্তায় কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এই ঘটনায় হামলাকারীদের দুজনকে ধাওয়া করে ধরে ফেলে প্রত্যক্ষদর্শীরা। এদের একজন পরে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয় বলে জানায় পুলিশ। ওয়াশিকুর রহমানের লেখালেখির অন্যতম একটি বিষয় ছিল ইসলামসহ নানা ধর্মের সমালোচনামূলক প্রসঙ্গ।

অনন্ত বিজয় দাস, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া শেষে পূবালী ব্যাংকের জাউয়াবাজার শাখায় ডেভেলপমেন্ট অফিসার পদে কর্মরত ছিলেন। বিজ্ঞান নিয়ে লেখালেখির পাশাপাশি তিনি যুক্তি নামে বিজ্ঞান বিষয়ক একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। এছাড়া বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন৷

২০১৫ সালের ১২ মে নিজের বাড়ির সামনে মুখোশধারীদের দ্বারা আক্রান্ত হন ৩২ বছরের এই সুদর্শন যুবক। সিলেটে সুবিদবাজারের নুরানি আবাসিক এলাকার চৌরাস্তার মোড়ে সকাল ১০ টায় দুর্বৃত্তরা তাকে কুপিয়ে হত্যা করে৷ এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সন্দেহের ভিত্তিতে ইদ্রিস আলী নামে একজন স্থানীয় ফটো সাংবাদিককে আটক করা হয়।

ব্লগার নিলাদ্রী চট্টোপাধ্যায়কেও দিনে দুপুরে বাড়িতে ঢুকে হত্যা করা হয়। প্রত্যেকটি হত্যাকাণ্ডই বলছে, নিহতদের দীর্ঘদিন ধরে অনুসরণ করা হয়েছে। প্রত্যেককেই ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। প্রত্যেকটি ঘটনার পরই ধর্মীয় মৌলবাদী সংগঠনের নামে দায় স্বীকার করা হয়েছে।

রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বরাবরই বলে আসছেন, বিচারহীনতার কারণে বাংলাদেশে এ ধরণের হত্যাকাণ্ড থামানো যাচ্ছে না। মামলাগুলোর তদন্তকারী সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসাররা বলছেন, উগ্র ধর্মীয় জঙ্গি গোষ্ঠী ‘স্লিপার সেল’ গঠন করে এ ধরনের হত্যার ঘটনা ঘটাচ্ছে। ‘কিলিং মিশনে’ অংশ নেয়ার আগে পর্যন্ত সেলের সদস্যরা একে অপরের কাছে অচেনা থাকে। এ কারণে একজন সদস্য অপর সদস্যের ব্যপারে বিস্তারিত কোন তথ্যই জানে না। ফলে একটি হত্যায় সরাসরি অংশগ্রহণকারীদের সঙ্গে অপর হত্যার কোন যোগসূত্র পাওয়া যাচ্ছে না।

মাত্র একটি ঘটনা ছাড়া ব্লগার খুন হওয়ার এতগুলো মামলার একটিরও বিচারের কাজ শেষ হয়নি। বেশ কিছু ক্ষেত্রে অভিযুক্তকে খুঁজে আদালতে হাজির করা হয়েছে। অভিযুক্তকে আসামি করে আদালতে চার্জশিটও দিয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। কিন্তু সব মামলাই শুধু বিচার প্রক্রিয়া দিয়েই যায়। শাস্তি হয় না অপরাধীদের। ফলে প্রতিবাদী কলমকে মেরে ফেলার ঘটনা বাড়ে।

বগুড়ায় জিয়া উদ্দিন জাকারিয়া বাবু হত্যার ঘটনায় তিনজন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছিল। ব্লগার নীলাদ্রি চট্রোপাধ্যায় হত্যা মামলায় দাবি করা হয় চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এছাড়া লেখক ও ব্লগার অভিজিত রায় ও প্রকাশক ফয়সাল আরেফীন দীপনসহ সাত ব্লগার হত্যা মামলার তদন্তে তেমন কোন অগ্রগতি নেই বলেই জানা গেছে।

রাজধানীতে খুন হয়েছেন অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাজিমউদ্দিন সামাদ। ২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর শাহবাগে আজিজ সুপার মার্কেটের তৃতীয় তলায় জাগৃতি প্রকাশনীতে ঢুকে প্রকাশক ফয়সাল আরেফীন দীপনকে গলা কেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।

একই সময়ে লালমাটিয়ায় অভিজিত রায়ের বইয়ের প্রকাশনী সংস্থা শুদ্ধস্বরের কার্যালয়ে ঢুকে প্রকাশক আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুল, ব্লগার রণদীপম বসু ও তারেক রহিমকে কুপিয়ে জখম করে মৌলবাদী ঘাতকরা। এই দুটি ঘটনায় শাহবাগ ও মোহাম্মদপুর থানায় দায়ের করা দুটি মামলার কোন বিচারই শেষ হয় নি৷

সোমবার রমজান মাস চলাকালিন ইফতারের ঠিক আগের মূহুর্ত্বে মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার কাকলদী গ্রামে খুন করা হয় ব্লগার শাহজাহান বাচ্চুকে। বিশাখা প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী, ব্লগার ও মুক্তমনা এই লেখককে গুলি করে হত্যা করে সেই মৌলবাদী দুষ্কৃতিরা। এখনও কাউকে গ্রেফতার করার ঘটনা চোখে পরেনি।

বাংলাদেশে লেখক ও প্রকাশক হত্যার প্রবণতা কি কমবে না? সরকারী উদাসিনতাই কি ‘মলমহীন কলম’ চিরতরে স্তব্ধ করে দেবার একমাত্র কারণ? সাধারণ মানুষের প্রতিবাদের মুখে কি পরতে হবে না বাংলাদেশ সরকারকে? প্রশ্ন কিন্তু উঠেই গেছে৷

kolkata24x7






মতামত দিন।

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*