প্রাণের ৭১

মরিচ চাষে সংসারে স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনছেন উত্তরবঙ্গের নারীরা

এক সময়ের হতদরিদ্র রাহেলা খাতুন মরিচ চাষ করে সংসারে স্বচ্ছলতা এনেছেন। রংপুর জেলার কাউনিয়া উপজেলার খুরডোভুটছাড়া গ্রামের বর্তমানে একজন সফল কৃষানী রাহেলা। কিন্তু ক’দিন আগেও অভাব ছিলো তার নিত্যসঙ্গী। সংসারে অশান্তি লেগেই ছিলো। বর্গাচাষী স্বামীর অভাব-অনটনের সংসার। এমনও দিন গেছে সারাদিন উপোষ থাকতে হতো তাদের পরিবারের সবাইকে। দুই ছেলে আর তিন মেয়ে নিয়ে নিদারুণ কষ্টে চলতো তাদের দিন।
এখন রাহেলার দিন পাল্টেছে। ছেলে-মেয়েরা এখন আর উপোষ থাকে না। তাদের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করেছেন রাহেলা।
এতোকিছু সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র রাহেলা খাতুনের প্রবল ইচ্ছা আর পরিশ্রমের কারণে। শুধুমাত্র মরিচ উৎপাদন করেই সংসারে স্বচ্ছলতা এনেছেন তিনি।
শুরুটা ছিলো অল্প পুঁজি আর তার নিজের বাড়ির চারপাশ জায়গাটুকু। সেখানেই তিনি চাষ করেন মরিচের। প্রথমবার মাত্র ৮ হাজার টাকা পুঁজি খাটিয়ে লাভ করেন প্রায় বিশ হাজার টাকা। আর তখনই তিনি সিদ্ধান্ত নেন আর নয় অভাবের সাথে সংসার। নিজের ভাগ্য ফেরাতে হবে নিজেকেই।
আর তার এই কাজে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় স্থানীয় বেসরকারী সাহায্য সংস্থা (এনজিও) সীড রি-কল প্রজেক্ট। এনজিও’র কর্মকর্তারা তাকে প্রশিক্ষণ দেন কিভাবে অল্প জায়গায় মরিচের বেশী ফলন পাওয়া যায়। শুরুতে তারা বিনামূল্যে উন্নত জাতের মরিচের বীজ সরবরাহ করেন রাহেলাকে। প্রশিক্ষণ নিয়ে স্বামী আর সন্তানদের সহযোগিতায় তিনি চাষ করেন মরিচের। পরেরবার তিনি তার স্বামীর জমিতেও মরিচ চাষ করেন। এবার তার লাভ হয় প্রায় ৪০ হাজার টাকা।
এ ব্যাপারে রাহেলা বলেন খুব অভাবের সংসার ছিল। ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখাতো দূরের কথা। তাদের ভালো করে খাবারই দিতে পারতাম না। সংসারে অশান্তি লেগেই থাকত।
এক দিন ওই এনজিও’র কয়েকজন আমার বাড়িতে আসেন। তারাই আমাকে এই কাজ শিখিয়ে দেন। আর স্বামী সোহরাব নিজেও একজন কৃষক। তার কাছ থেকেও অনেক কিছু শিখেছি।
তিনি বলেন আমি মূলত সবুজ এবং লাল মরিচ উৎপাদন করি। কম পুঁজিতে অনেক লাভ। এখন প্রতি বছর দেড় থেকে দুই লাখ টাকা লাভ হয় আমার। সংসারেও শান্তি এসেছে।
রাহেলার মতো মরিচ চাষ করে লাভবান হয়েছেন তারই গ্রামের আরেক কৃষাণী মহনোয়ারা বেগম। তার সংসারেও অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী।
মনোয়ারা বলেন, আল্লাহ আমাদের মুখ তুলে চেয়েছেন। এই মরিচ চাষ এবং তা বিক্রি করেই আমি ঘর তুলেছি। মেয়ের বিয়ে দিয়েছি মরিচ বিক্রির লাভের টাকায়। তিনি কৃতজ্ঞতা জানান রি-কল প্রোজেক্টের কর্মকর্তাদের। তিনি বলেন, মূলত তাদের অনুপ্রেরণায় আমি এই কাজে নেমেছি। শুরুতে কিছু টাকা লোন নিয়ে আর কয়েক শতক জমি বর্গা নিয়ে আমি মরিচ চাষ শুরু করি। এখন আর জমি বর্গা নিতে হয় না। আমি নিজেই অল্প জমি কিনেছি।
সীড রি-কল প্রজেক্ট কর্মকর্তা মারিয়া বলেন, এই অঞ্চলের অধিকাংশ মহিলারাই অনেক পরিশ্রমী। তারা সারাদিন পরিশ্রম করতে পারেন। কিন্তু তারা জানেন না তাদের এই পরিশ্রমকে কিভাবে লাভে রূপান্তর করতে হয়।
তিনি বলেন, রাহেলার মতো এই গ্রাম এবং আশপাশের অনেক মহিলাই এখন মরিচ চাষ করে লাভবান হয়েছেন। এসব মহিলারাই এখন সংসারের প্রধান উপার্জনকারী। অথচ কিছুদিন আগেও এই অঞ্চলের অধিকাংশ মহিলা স্বামীর হাতে প্রতিনিয়ত নির্যাতনের শিকার হতো। সংসারের অভাবই মূলত এর জন্য দায়ী। পুরুষরা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় চলে যেতেন কর্মসংস্থানের খোঁজে। কিন্তু এখন দিন পাল্টেছে। তারা এখন চাষাবাদ করেই সংসারের হাল ধরেছেন।
তিনি বলেন, এসব কৃষাণীদের যদি সঠিক প্রশিক্ষণ দিয়ে সঠিক কাজে লাগানো যায় তবে দেশ অনেক এগিয়ে যাবে। তিনি বলেন, নারীদের ক্ষমতায়ন করতে না পারলে কোন দেশে নারী এবং পুরুষের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা হয় না। নারীদের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রয়োজন দেশের প্রতিটি নারীর আর্থ-সামজিক উন্নয়ন।






মতামত দিন।

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*