প্রাণের ৭১

মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস

রোহিঙ্গা সংকটকে নিজের দেখা এযাবৎকালের সবচেয়ে ভয়াবহ সমস্যা হিসেবে অভিহিত করে তা মোকাবেলায় বাংলাদেশকে সহযোগিতা ও মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। ভারত সফরের দ্বিতীয় দিনে গতকাল মঙ্গলবার তিনি নয়াদিল্লিতে ‘বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ, বৈশ্বিক সমাধান’ শীর্ষক বক্তব্য অনুষ্ঠানে এ আহ্বান জানান।

এক প্রশ্নের উত্তর তিনি বলেন, আজকাল সন্ত্রাস, সহিংস উগ্রবাদ নিয়ে সবাই উদ্বিগ্ন। রোহিঙ্গারা যে নাজুক ও অধিকারহীন অবস্থায় আছে তাতে সন্ত্রাসীরা তাদের দলে টানতে উদ্বুদ্ধ হবে। এ সমস্যা সমাধান না হলে শুধু বাংলাদেশ, মিয়ানমার নয়, পুরো অঞ্চলই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, রোহিঙ্গাদের নিজ বাসভূমিতে ফিরে যাওয়া ও স্বাভাবিক অধিকার পাওয়ার নিশ্চয়তা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো তাদের নাগরিকত্ব পাওয়া।

মিয়ানমারের ওপর জাতিসংঘ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে কি ইতিবাচক ফল আসবে—এ প্রশ্নের উত্তরে জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, রোহিঙ্গারা যে ধরনের অপরাধের শিকার হয়েছে, সেগুলো বেশ গুরুতর। তিনি মনে করেন, এ ধরনের অপরাধের জবাবদিহি থাকা প্রয়োজন।

বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের (আইসিসি) সুযোগ কাজে লাগিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আইসিসির উদ্যোগ কাজে আসবে কি না, তিনি তা জানেন না। তবে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে যা হয়েছে, তা অবিশ্বাস্য।

ভারত কী করতে পারে—এমন প্রশ্নের উত্তরে জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, ‘বাংলাদেশকে সহযোগিতা করুন। কারণ সেখানে বড় মানবিক সমস্যা। বর্ষা মৌসুম শেষ হচ্ছে। অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ প্রেক্ষাপটে বিপর্যয় ঠেকানো জরুরি। ’

তিনি বলেন, ‘মানবিক সংস্থাগুলো বিশাল বিনিয়োগ করেছে। এর পরও তা যথেষ্ট নয়। ওই লোকগুলোর (রোহিঙ্গাদের) জন্য তাই বাংলাদেশকে সহযোগিতা করুন। ’

ভারতকে উদ্দেশ করে জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, ‘মিয়ানমারের, বিশেষ করে, ওই দেশটির সামরিক বাহিনীর ওপর চাপ সৃষ্টি করুন। ভৌত অবকাঠামোর জন্য বড় বিনিয়োগ প্রয়োজন। কিন্তু ওই লোকগুলোর ফেরার পরিবেশ সৃষ্টি, পুনর্মিলনের জন্য বিনিয়োগ করুন। ’

জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ থেকে ফিরে যাবে না। কারণ তারা মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে ভয়ের মধ্যে আছে। আর সেখানে পরিস্থিতি যা, তাতে তারা সম্মানজনক জীবনযাপন পাবে না।

তিনি বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, ভারতের মতো দেশের মিয়ানমারের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক আছে এবং সম্ভাব্য সব ধরনের চাপ সৃষ্টি করতে পারে। ভারত চীন ও অন্যরা মিলে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ফেরার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য চাপ সৃষ্টি করতে পারে। ’

কেউ এত বৈষম্যের শিকার হয়নি : জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, ‘অতীতে আমি শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার হিসেবে বেশ কয়েকবার মিয়ানমারের উত্তর রাখাইন রাজ্য সফর করেছি। আমি বিশ্বে রোহিঙ্গাদের মতো এত বৈষম্যের শিকার হওয়া কোনো সম্প্রদায় দেখিনি। তাদের চলাফেরার কোনো অধিকার নেই। এক জায়গা থেকে অন্যত্র, এত গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যেতে পুলিশের কাছে তাদের অনুমতি চাইতে হয়। পুলিশের হয়রানি, দুর্নীতির কথা আপনারা জানেন। ’

তিনি বলেন, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে অনুমতি ছাড়া বিয়ে করতে পারে না। বেশির ভাগ শিশুরই স্কুলে সামান্য শিক্ষা নিতে যাওয়ারও সুযোগ নেই। তারা ইয়াঙ্গুনে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যেতে পারে না। স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকারও সীমিত। চাকরি পাওয়ার অধিকারও অত্যন্ত সীমিত। ’

জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, ‘কয়েক বছর আগে মিয়ানমার প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা রোহিঙ্গাদের বিষয়ে আমাকে বলছিলেন, ‘ওদের দেখুন। ওরা কালো, কুৎসিত। ওরা আমাদের মতো নয়। ’ তিনি বলেন, বৌদ্ধ অধ্যুষিত মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে। সেখানে বর্ণবাদের শিকড় অনেক গভীরে।

রোহিঙ্গাদের আগেই বের করে দিতে চেয়েছিল মিয়ানমার : জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, ‘মিয়ানমারের বর্তমান সরকারের আগের সরকারের আমলে অভ্যন্তরীণভাবে অনেক বাস্তুচ্যুতির ঘটনা ঘটেছে। রোহিঙ্গারা বাস্তুচ্যুত হয়েছে। মিয়ানমারে এখনো প্রায় ৪০ হাজার রোহিঙ্গা অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত অবস্থায় আছে। মিয়ানমারের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আমাকে বলছিলেন তাদের অন্য দেশে পুনর্বাসন করতে। তাদের শরণার্থী বানাতে। ’

মহাসচিব বলেন, ‘আমি তাঁকে বলেছি, এটি আমার কাজ নয়। আমার কাজ সমস্যা সমাধান করা, শরণার্থী তৈরি করা নয়। ’ তিনি বলেন, এ থেকেই বোঝা যায় যে রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে মিয়ানমার কতটা নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে।

মিয়ানমারে সব সময় মুসলমানরা ছিল : জাতিসংঘ মহাসচিব নয়াদিল্লিতে দর্শক-শ্রোতাদের উদ্দেশে বলেন, ‘মনে রাখবেন, মিয়ানমারে পুরনো আরাকান রাজ্যের সময় থেকেই সব সময় মুসলমান অনেক আগে থেকেই ছিল। ’

তিনি বলেন, কিছু সন্ন্যাসীর ঘৃণ্য প্রচারণার কারণে মিয়ানমার সমাজে রোহিঙ্গাবিরোধী বিদ্বেষ জোরালো হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারণা চালানো হয়, ওরা মিয়ানমারের নয়। এরা সেখানে ছিল না। তাদের দেশ ছেড়ে যাওয়া উচিত।
‘এগুলো সত্য নয়’ বলে মন্তব্য করে জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, ‘ব্রিটিশ উপনিবেশ আমলে লোকজন এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গেছে। ক্যারিবীয় অঞ্চলে অনেক ভারতীয় গেছে। এখন কি আপনে ভাবতে পারেন যে ক্যারিবীয় বলছে তোমরা ভারতে ফিরে যাও। এটি হাস্যকর। মিয়ানমারে যারা গেছে তাদের ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য। ’

বর্বরতা গ্রহণযোগ্য নয় : জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমারে অব্যাহত নেতিবাচক প্রচারণার ফলে পুলিশ স্টেশনে ভয়ংকর কিছু সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে পরে মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলে জাতিগত নির্মূল হয়েছে।

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞের উদ্বেগ : ভারতে আটক সাত রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগে উদ্বেগ জানিয়েছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ তেনদাঈ আচিউমি। গত রাতে এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে ২০১২ সাল থেকে ওই রোহিঙ্গারা আসাম রাজ্যের কাছার জেলার সিলচর কেন্দ্রীয় কারাগারে আছে। আজ বুধবার তাদের ফেরত পাঠানো হতে পারে। তাদের জোরপূর্বক মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো আশ্রয়প্রার্থী শরণার্থীকে বহিষ্কার হিসেবে হতে পারে এবং এটি আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন।






মতামত দিন।

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*