প্রাণের ৭১

রাজনীতি

পরিচ্ছন্ন একজন রাজনৈতিক বীর মুক্তিযোদ্ধা ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনর


img

মোহাম্মদ হাসান:

ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন (জন্মঃ ১২ জানুয়ারি ১৯৪৩) একজন বাংলাদেশী রাজনীতিবিদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও প্রথম সারির শিল্পপতিদের অন্যতম। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সংসদ সদস্য ও সরকারের গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রনালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী। রাজনৈতিক অঙ্গনে তিনি দেশের প্রাচীনতম ও ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী পদ প্রেসিডিয়াম সদস্য। তার নির্বাচনী আসন চট্টগ্রাম – ১ (মীরসরাই)। তিনি ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের বেসামরিক বিমান চলাচল ও পরিবহন এবং গৃহায়ন ও পর্যটন মন্ত্রনালয়ের দায়িক্ত পালন করেন। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন তিনি। বর্তমানে তিনি গৃহায়ন ও গনপূর্ত মন্ত্রনালয়ের দায়িত্বে মন্ত্রী হিসেবে নিয়োজিত আছেন ৷

প্রারম্ভিক জীবনঃ
১৯৪৩ সালের ১২ জানুয়ারি তারিখে চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার ধুম গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন পাশ করেন। ১৯৬২ সালে স্যার আশুতোশ কলেজ থেকে তিনি এইচএসসি পরীক্ষায় পাশ করেন। ১৯৬৬ সালে লাহোরের ইঞ্জিনিয়ারিং ও কারিগরী বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইনিং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বিএসসি সম্পন্ন করেন তিনি।তাঁর পিতা এস.রহমান ১৯৬০ সালের দিকে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ও নামকরা ব্যবসায়ী ছিলেন। এস. রহমান ১৯৪৪ সালে কলকাতায় তার ব্যবসা শুরু করেন। ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর তিনি চট্টগ্রাম চলে আসেন। চট্টগ্রামে তিনি“ওরিয়েন্ট বিল্ডার্স কর্পোরেশন” নামক একটি অবকাঠামো উন্নয়ণ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন যার মাধ্যমে তিনি অনেক রাস্তা, ভবন ও বাংলাদেশের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা গড়ে তুলেন। এছাড়াও তিনি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত

২০টি বিলাসবহুল মার্সিডিজ বাসের বহর চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার ও অন্যান্য এলাকার সঙ্গে প্রবর্তন করেন। এস.রহমান কক্সবাজার যে কত্তবড় পর্যটন স্পট হবে তা আগে থেকে আঁচ করতে পেরেছিলেন। যারই প্রেক্ষিতে তিনিই সর্বপ্রথম কক্সবাজারে হোটেল প্রতিষ্ঠা করেন। আর সেটি হলো ১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘হোটেল সায়েমন’। বর্তমানেও এটি কক্সবাজারের হোটেলগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান একটি হোটেল হিসেবে বিবেচিত। কক্সবাজারের পর্যটন শিল্প প্রসারে তার এ পদক্ষেপ এখনও চট্টগ্রাম কক্সবাজারের মানুষ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। এছাড়াও তিনি চট্টগ্রামে তৎকালীন সময়ে পর্যটকদের একমাত্র আবাসিক হোটেল ‘‘মোটেল সৈকত’’ দীর্ঘ ১০ বছর পরিচালনা এবং চট্টগ্রামে একটি রোপ ফ্যক্টরী ও হার্ডওয়ার ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করেন। মোশাররফ হোসেনের পিতামহ ফজলুর রহমান দীর্ঘ ২০ বৎসর যাবৎ চট্টগ্রাম মীরসরাইয়ে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন।

মনে প্রাণে একটি রাজনৈতিক আদর্শকে লালন করে দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করতে গিয়ে অর্থনৈতিক দুর্বলতা যেন জনসেবা থেকে তাকে দূরে রাখতে না পারে সে জন্য রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনার পাশাপাশি তিনি তার পৈতৃক ব্যবসাসমূহ দেখাশুনা করেন। এক পর্যায়ে ১৯৮৩ সালে গ্যাসমিন লিমিটেড নামে একটি Engineering & Construction Firm প্রতিষ্ঠা করেন। তার প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘদিন ধরে দেশের গুরুত্বপূর্ণ পাইপ লাইনের কাজ করে আসছে। ১৯৬৪ সালে কক্সবাজারে তার পিতার প্রতিষ্ঠিত হোটেল সায়মনকে পরবর্তীতে আরো সম্প্রসারণ করে ব্যবসার পরিধি বৃদ্ধি করেন। এছাড়া তিনি ‘পেনিনসুলা চিটাগাং’ নামক একটি আন্তর্জাতিক মানের চার তারকা হোটেলের চেয়ারম্যান।

দাম্পত্য জীবনে তিনি স্ত্রী আয়েশা সুলতানার সাথে সংসার করছেন। তার তিন ছেলে এবং একজন মেয়ে রয়েছে।

শিক্ষাজীবনঃ
তিনি চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন পাশ করেন। ১৯৬২ সালে স্যার আশুতোশ কলেজ থেকে তিনি এইচএসসি পরীক্ষায় পাশ করেন। ১৯৬৬ সালে লাহোরের ইঞ্জিনিয়ারিং ও কারিগরী বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইনিং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বিএসসি সম্পন্ন করেন তিনি।

রাজনীতিঃ
লাহোরে অধ্যয়নকালে তিনি ছয় দফা আন্দোলনের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করে বিভিন্ন সময় মিছিল সমাবেশে সরাসরি নেতৃত্ব দেন। এসময় তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৬ সালে ছয় দফার যৌক্তিকতা তুলে ধরে লাহোরে পূর্ব পাকিস্তানে অধ্যয়নরত ছাত্রদের সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র পরিষদের এক সমাবেশে তিনি সভাপতিত্ব করেন। লাহোর থেকে দেশে ফিরে মানুষের কল্যাণ করার মহান ব্রত নিয়ে চট্টল শার্দুল এম.এ. আজিজের হাত ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত এবং স্বাধীনতা আন্দোলনে অতপ্রোতভাবে জড়িত হন। ১৯৭০ সালে তিনি সর্বপ্রথম তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। স্বাধীনতার পর তিনি ১৯৭৩, ১৯৮৬, ১৯৯৬, ২০০৮ সালে এবং গত ০৫ জানুয়ারী ২০১৪ খ্রিঃ তারিখে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭২ সালে তিনি সংবিধান প্রণেতাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। ১৯৮৬ সালে জাতীয় সংসদে তিনি বিরোধী দলীয় হুইপের এবং ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারে তিনি অত্যন্ত দক্ষতা ও সততার সাথে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৮ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি জাতীয় সংসদে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। রাজনীতিতে আসার পর তিনি দলের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালে তিনি চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বাকশাল এবং ’৭৭ সালে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহবায়কের দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া ১৯৮০ ও ৮৪ সালে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৯২, ১৯৯৬, ২০০৪ এবং ২০১২ সালে সভাপতি এবং একই সাথে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। একজন সৎ, ভদ্র, নম্র, স্পষ্টবাদী ও উদার মনোভাবের মানুষ হিসেবে নিজ দলের নেতাকর্মীসহ চট্টগ্রামের সর্বস্তরের মানুষের নিকট তার সুনাম রয়েছে। রাজনীতি করতে গিয়ে এ সুদীর্ঘ সময়ে তিনি কখনও কোন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে আশ্রয় প্রশ্রয় দেননি এবং কোন সন্ত্রাসী লালন করেননি। তিনি কখনও নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে আপোষ করেননি। ’৭৫ পরবর্তী বিভিন্ন সরকারের মন্ত্রী পরিষদে অন্তর্ভূক্ত হওয়ার আহবান তিনি দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেন এবং নিজ দলের আদর্শে অবিচল থেকেছেন সব সময়। রাজনীতি করতে এসে মুক্তিযুদ্ধসহ বহুবার তিনি জীবন মৃত্যুর মুখোমুখী হয়েছেন, নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ১৯৮০ সালে চট্টগ্রামের নিউমার্কেট চত্বরে তৎকালীন বিএনপি’র সশস্ত্র সন্ত্রাসী কর্তৃক তিনি এবং আওয়ামীলীগের অনেক নেতৃবৃন্দ আক্রান্ত হন। এসময় সন্ত্রাসীরা তাঁর পায়ের রগ কেটে দেয়। ’৮৮ সালে ২৪শে জানুয়ারী শেখ হাসিনার মিছিলে পুলিশ কর্তৃক গুলি চালিয়ে ২৪ জনকে হত্যা করার ঘটনায় তিনিও মারাত্মকভাবে আহত হন। ’৯২ সালের ৮ মে ফটিকছড়িতে জামায়াত ক্যাডারদের সশস্ত্র হামলায় গুরুতর আহত হয়ে অলৈাকিকভাবে প্রাণে বেঁচে যান তিনি। ২০১৫ সালে তিনি গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বগ্রহণ করেন। [২]

মুক্তিযুদ্ধঃ
মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি সেক্টর – ১ এর সাব – সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। পাক-হানাদারদের বাঙালি নিধন এর নীলছক এর কালোরাত্রির তান্ডবটি শুধুমাত্র ঢাকা ও অন্য জেলাগুলোতে নয়, দেশের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ শহর ও বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামেও হওয়ার কথা ছিল। তারই প্রক্রিয়ায় বাঙালী জাতীয়তাবাদে উদ্ধুদ্ব ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে চট্টগ্রাম থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছিল। চট্টগ্রামে বাঙালি ও পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য ছিল যথাক্রমে প্রায় ৫ হাজার ও ৬শত। বাঙালী সৈন্যদের মধ্যে ছিল ইস্ট বেঙ্গল সেন্টারে নব-গঠিত অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল এর নতুন প্রায় ২৫০০ জন প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা। ছিল ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস এর উইং ও সেক্টর হেড কোয়ার্টার এর রাইফেলসরা এবং পুলিশ বাহিনী। পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা ছিল মূলত ২০-বালুচ এর। ২৫ শে মার্চ এর বিধ্বংসী কালোরাত চট্টগ্রামে পুনরাবৃত্তি করার জন্য চট্টগ্রামের সিনিয়র অবাঙালী অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফতেমিকে আদেশ দেয়া হয়, কুমিল্লা থেকে অতিরিক্ত সৈন্য পৌছানোর মধ্যে যেন সমন্ত পরিস্থিতি নিজের অনুকূলে ধরে রাখেন।

চট্টগ্রামে কালোরাত্রির নৃশংসতা ঠেকাতে ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের নেতৃত্বে সাহসী বীর বাঙালী যোদ্ধারা শুভপুর ব্রীজ উড়িয়ে দিয়ে কুমিল্লা থেকে আগমনকারী সেনাদলের পথ বন্ধ করে দেন এবং চট্টগ্রাম শহর ও ক্যান্টনমেন্টের প্রধান প্রধান এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রনে এনে ফেলেন।পরবর্তীতে তিনি সি.ইন.সি স্পেশাল ট্রেনিং নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন পরিচালনা করেন।






মতামত দিন।

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*