প্রাণের ৭১

শবেবরাত একটি মহিমান্বিত, তাৎপর্যমণ্ডিত ও ফজিলতপূর্ণ রাত

শাবান মাসের পঞ্চদশ রজনী তথা শবেবরাত মুসলিম উম্মাহর কাছে একটি মহিমান্বিত, তাৎপর্যমণ্ডিত ও ফজিলতপূর্ণ রাত। রাসূল (দ.) হাদিসে এ মহিমান্বিত রাতকে ‘লাইলাতুন নিসফে মিন শাবান’ তথা পনেরো শাবানের রাত বলেছেন।

ফার্সি শব্দ ‘শব’ অর্থ রাত/রজনী। আর বারাআত অর্থ মুক্তি, নিষ্কৃতি, অব্যাহতি, পবিত্রতা ইত্যাদি। সুতরাং শবে বরাতের শাব্দিক অর্থ দাঁড়ায়- মুক্তি, নিষ্কৃতি ও অব্যাহতির রজনী। এ রাতে যেহেতু আল্লাহ তা‘আলা পাপী লোকদের ক্ষমা করেন, নিষ্কৃতি দেন ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন, সেহেতু এ রাতকে লাইলাতুল বারাআত বা শবে বরাত বলা হয়।

কুরআনের আলোকে শবে বরাত:
পবিত্র কুরআনের সুরা দুখানের প্রথম পাঁচ আয়াতে এ রাতের বর্ণনা এসেছে। অনেকে এ আয়াতসমূহ দ্বারা শবে কদর উদ্দেশ্য করলেও কেউ শবে বরাতকে অস্বীকার করেননি। বরং তারাও আলাদা আলাদা ভাবে শবে বরাতের ফযিলত বর্ণনা করেছেন। যে সমস্ত তাফসিরের কিতাবে এ আয়াতসমূহের তাফসীর শবে বরাত করেছেন, তা হলো- তাফসীরে কবীর, তাফসীরে রুহুল মাআনী, তাফসীরে রুহুল বায়ান, তাফসীরে কুরতুবী,তাফসীরে খাযেন, তাফসীরে ইবনে কাসির ইত্যাদি।

হাদিসের আলোকে শবে বরাত:
সিহাহ সিত্তার কিতাব ‘তিরমিযি ও ইবনে মাযা’ শরীফে শবে বরাতের সমর্থনে ‘বা-বু মা জা-আ ফি লাইলাতুন নিসফে মিন শা’বান’ নামক দুটি অধ্যায় রচনা করেছেন। এ ছাড়াও ইমাম তাবরানি রচিত ‘আল কাবির’, ইমাম বায়হাকি রচিত ‘শুয়াবুল ইমান’, ইমাম ইবনে হিব্বান রচিত ‘সহীহ ইবনে হিব্বান’, ‘মুসনাদে ইমাম আহমদ’ ও ‘মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা’ সহ অনেক হাদিসের কিতাবে এ রাতের সমর্থনে হাদিস বর্ণিত রয়েছে। যেমন ‘সহীহ ইবনে হিব্বানে’ হযরত মু’আয ইবনে জাবাল (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ তায়ালা মধ্য শাবানের রাত্রে (শবে বরাতে) তার সৃষ্টির মধ্যে আবির্ভূত হন (রহমত নাযিল করেন)। অতঃপর মুশরিক বা হিংসুক ব্যতীত সমস্ত সৃষ্টিকে ক্ষমা করে দেন। অপর হাদিসে হযরত আবু বকর (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যখন অর্ধ শা’বান (শবে বরা’আত) আগমন করে, আল্লাহ তায়ালা (তার শান অনুযায়ী) দুনিয়ার নিকটবর্তী আসমানে অবতরণ করেন (রহমত, বরকত ও মাগফিরাত অবতরণ করে)। অতঃপর তিনি তার বান্দাদের ক্ষমা করে দেন। তবে মুশরিক এবং যে ব্যক্তি অপর ভাইয়ের প্রতি হিংসা রাখে, সে ব্যতীত’।(ইমাম বায়হাকী- শুয়াবুল ঈমান)।

এ ব্যাপারে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্ণনা এসেছে, নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা শা’বানের মধ্য রাত্রিতে তার সৃষ্টির মাঝে অবতীর্ণ হন (করুণা অবতীর্ণ করেন)। অতঃপর দুই শ্রেণী ব্যতীত তার সমস্ত বান্দাদের ক্ষমা করে দেন। আর উভয় শ্রেণী হচ্ছে, হিংসুক ও খুনি’ (মুসনাদে ইমাম আহমদ)।এই রাতের ফজিলত:

এ প্রসঙ্গে হযরত আয়শা (রা.) থেকে একটি হাদিস বর্ণিত আছে যে, নবী করিম (দ.) হযরত আয়শা (রা.) কে সম্বোধন করে বললেন, হে আয়শা! এ রাতে কি হয় জানো? হযরত আয়শা (রা.) বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। রাসূল (দ.) বললেন, এ রাতে আগামী বছর যত শিশু জন্ম নিবে এবং যত লোক মারা যাবে তাদের নাম লেখা হয়, মানুষের বিগত বছরের সব আমল আল্লাহর দরবারে পেশ করা হয় এবং মানুষের রিযিক অবতীর্ণ হয়। (মিশকাত শরীফ)

হযরত আতা বিন ইয়াসির (রা.) থেকে বর্ণিত,যখন শা’বানের মধ্যরাত উপস্থিত হয়, তখন মালাকুল মউত এর কাছে একটি রেকর্ডবুক অর্পণ করে নির্দেশ দেয়া হয় যে, এই বইয়ে যাদের নাম উল্লেখ আছে, তাদের জান কবজ কর। (লাতায়িফুল মায়ারিফ)

শবে বরাতের করণীয়:
শবে বরাত মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে উম্মতে মুহাম্মাদির জন্য এক বিশেষ উপহার, তাই এ রাতে আমাদের করণীয় ইবাদাত সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হল।
(১) রাত জেগে ইবাদাত করা। যেমন- নফল নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত, জিকির, তওবা-ইস্তিগফার ইত্যাদি। কেননা হাদিসে পাকে এসেছে- এ রাতে সূর্যাস্তের সাথে সাথে আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীর আকাশে বিশেষ রহমতের দৃষ্টি দেন এবং ফজর পর্যন্ত মানুষকে তাঁর কাছে ক্ষমা, রোগ মুক্তি, জাহান্নাম থেকে মুক্তি, রিযিক ইত্যাদি বৈধ প্রয়োজনীয় সবকিছু প্রার্থনা করার জন্য আহ্বান করতে থাকেন। (শুয়াবুল ইমান)

(২) পরদিন রোজা রাখা, কেননা হযরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (দ.) ইরশাদ করেছেন- ‘পনেরো শাবানের রাত জেগে ইবাদাত কর এবং পরদিন রোযা রাখা।

(৩) কবর জিয়ারত করা। যেমন হাদিসে পাকের ইরশাদ- হযরত আয়শা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি এক রাতে রাসূল (দ.) কে বিছানায় পেলাম না। অতঃপর আমি তাঁকে খুঁজতে বের হলাম। অবশেষে তাকে জান্নাতুল বাকীতে পেলাম। আমাকে দেখে তিনি বললেন, হে আয়শা, তুমি কি আশঙ্কা করছ যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তোমার প্রতি অবিচার করবেন? হযরত আয়শা বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, আমি ধারণা করেছিলাম, আপনি হয়তো আপনার অন্য কোন স্ত্রীর ঘরে তশরিফ নিয়েছেন। অতঃপর রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, পনেরো শাবান আল্লাহ তা‘আলা পৃথিবীর আকাশে তাজাল্লী বর্ষণ করেন এবং বনু-কাল্ব গোত্রের ভেড়া-বকরির পশম অপেক্ষা অধিক লোককে ক্ষমা করেন (তিরমিযী)।
উল্লেখ্য, আরবে বনু কালবের অধিক ভেড়া-বকরি ছিল।

শবে বরাতে বর্জনীয়:
রাসূল (দ.) স্বীয় জীবনে এ রাত বারবার পেয়েছেন, আমল করেছেন। তারপর সাহাবায়ে কিরাম, তাবেয়ীন, তাবে তাবেয়ীন এবং যুগে যুগে ওলামা ও মাশাইখে কিরাম এ রাতে ইবাদাত করে গেছেন। তাদের রেখে যাওয়া আদর্শই আমাদের অনুসরণ করা উচিৎ। আমাদের দেশে শবে বরাতে প্রচলিত কিছু বর্জনীয় কার্যকলাপ নিম্নে পেশ করা হলো।

(১) অনেকেই এ রাতে হালুয়া রুটির ব্যবস্থা করেন। এটা মুসতাহাসান। কেননা মা আয়েশা (রা.) থেকে বলেন, রাসূল (দ.) এর নিকট পছন্দনীয় ছিলো হালওয়া ও মধু (বোখারী) এখানে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে এটাকে শবে বরাতের অবিচ্ছেদ্য অংশ যেমনি মনে করা যাবে না, তেমনি হারাম বা নাজায়েজও বলা যাবে না। দুটাই গোমরাহি।

(২) অনেকেই এ রাতে আতশবাজি, শোরগোল ও হৈ চৈ সহ নানা ধরনের অনৈসলামিক কাজ করে থাকেন, যা পরিপূর্ণ কুসংস্কার ও গুনাহের কাজ। ইসলামে এসবের কোন স্থান নেই।

(৩) অযথা রাস্তা-ঘাটে গল্পগুজব, খেলাধুলা, টিভি দেখা ইত্যাদি দুনিয়াবি কাজ বর্জন করা।

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের যথাযথভাবে শবেবরাত পালন করার তৌফিক দান করুক। আমীন! বেহুরমাতে সায়্যিদুল মুরসালিন।






মতামত দিন।

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*