প্রাণের ৭১

শান্তিতে নোভেল বিজয়ী ইসলামী স্টেটের যৌনদাসী।

চলতি বছর শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন কঙ্গোর ধাত্রীবিদ্যাবিশারদ ডেনিস মুকওয়েজি এবং ইসলামিক স্টেট (আইএস) জঙ্গিদের হাতে ধর্ষণের শিকার ইরাকের ইয়াজিদি নারী নাদিয়া। যৌন সহিংসতা ও হয়রানিকে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার বন্ধে লড়াইয়ের স্বীকৃতি স্বরুপ তারা এই পুরস্কারে ভুষিত হয়েছেন।

শুক্রবার সুইডেনের স্থানীয় সময় সকাল ১১টায় নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি শান্তিতে নোবেল বিজয়ী হিসেবে এই দুই কর্মীর নাম ঘোষণা করেছে। যুদ্ধের সময় অস্ত্র হিসেবে যৌন সহিংসতার ব্যবহারের অবসানের লক্ষ্যে কাজ করে আসছেন এ দুই নোবেলজয়ী।

পাকিস্তানের নারী শিক্ষা অধিকার কর্মী মালালা ইউসুফ জাইয়ের পর সবচেয়ে কমবয়সী হিসেবে বিশ্বের সর্বোচ্চ সম্মানজনক এই পুরস্কার জিতলেন ইয়াজিদি এই তরুণী। পুরো নাম নাদিয়া মুরাদ। বয়স ২৫।

জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) হাতে উত্তর ইরাকের ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের এই তরুণী তিন মাস জিম্মি ছিলেন। এই সময়ে আইএস জঙ্গিরা তাকে ব্যবহার করেছে যৌনদাসী হিসেবে। ভয়ংকর সেই সময়ে চোখের সামনে আইএস জঙ্গিরা তার ছয় ভাই ও মাকে খুন করেছে। দুঃসহ সেই স্মৃতি এখনো ভুলতে পারেন না তিনি।

আইএসের যৌন আস্তানা থেকে পালিয়ে আসার পর ২০১৬ সালে সেন্ট্রাল লন্ডনের ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস হাউসে দেয়া এক বক্তৃতায় আইএস জঙ্গিদের যৌন তাণ্ডব ও নৃশংসতার কথা তুলে ধরেছিলেন নাদিয়া।

ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান বলছে, ২০১৪ সালের আগস্টে উত্তর ইরাকের একটি গ্রামে হানা দেয় ইসলামিক স্টেট (আইএস) জঙ্গিরা। গ্রামের অন্যান্য নারীদের সঙ্গে নাদিয়াকে অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে যায় তারা। জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) সদস্যরা তাকে সেখানে তিন মাস যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহার করে।

আইএসের হাতে বন্দিকালীন কীভাবে শত শত ইয়াজিদি নারীকে যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহার করা হতো সেই ভয়ানক অভিজ্ঞতার কথা জানাতে নাদিয়া হাতে তুলে নিয়েছিলেন কলম। ‘দ্য লাস্ট গার্ল’ নামে লেখা একটি বইয়ে সেই কাহিনি তুলে ধরেন তিনি।

উত্তর ইরাকের আইএস জঙ্গিদের কবল থেকে পালিয়ে এসে লন্ডনের এক হোটেলে বসে সেই দিনগুলোর কথা ব্রিটিশ গণামাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন। সেই সময় নাদিয়া মুরাদ বলেন, ‘কাউকে না কাউকে তো এসব কথা তুলে ধরতেই হতো। ’

বর্তমানে জাতিসংঘের শুভেচ্ছা দূত হিসেবে কাজ করছেন তিনি। আইএস জঙ্গিদের হাতে বন্দি ইয়াজিদি নারী এবং যারা জঙ্গিদের হাত থেকে পালিয়ে এসেছে তাদের নিয়ে কাজ করছেন নাদিয়া।

সাক্ষাত্কারে নাদিয়া বলেন, ২০১৪ সালের কথা। তখন আইএস জঙ্গিদের দখলে চলে গেছে পুরো উত্তর ইরাক।

ইরাকের এ অংশে ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের অনেক মানুষ থাকতেন। জঙ্গিরা এসে গ্রামের পর গ্রাম উজাড় করে দেয়। খুন, ধর্ষণ, লুটপাটের পাশাপাশি ইয়াজিদি নারী, তরুণী, কিশোরীদের তুলে নিয়ে যেতে শুরু করে। চলে তাদের যৌনদাসী বানানোর কাজ।

নাদিয়া সেই সময় দাবি করেন, একজন তার পেটে সিগারেটের আগুনে ছ্যাঁকা দেয়। সেই ব্যক্তিই তাকে কিনে নেয়। অনেক ইয়াজিদি নারী সম্ভ্রম বাঁচাতে আত্মহত্যা করেন। মুরাদ বলেন, ‘নরক থেকে পালানোর চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ধরা পড়ে গিয়েছিলাম। ধরা পড়তেই চলে গণধর্ষণ। ভেঙে পড়িনি। আমার মতোই হাজারো নারী জঙ্গিদের কব্জায় ছিল, এটাই আমাকে সাহস জুগিয়েছিল। নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে বলতে থাকলাম একদিন মুক্ত হবোই। ’

‘সেই সুযোগও এসে গেল একদিন। এক জঙ্গি দরজা না আটকে বেরিয়ে যায়। আইএসের সেই জঙ্গি চলে যেতেই দৌড় শুরু করেন তিনি। আর পেছনে ফিরে তাকাননি। ধরা পড়লেই মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও সাহসে ভর করে বেরিয়ে পড়েছিলাম। ’

অন্ধকার রাস্তা ধরে দীর্ঘ পথ হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে এক বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় চান। সেই পরিবারই তাকে মসুল থেকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেন। পরে ২০১৫ সালে জার্মানির শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নেন তিনি। তিনি বলেন, ‘জানি কী দুর্বিষহ দিন কাটাচ্ছেন তারা। নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই আজ সেই সব মেয়েদের কাহিনি তুলে ধরছি। ’

নাদিয়া মুরাদ বলেন, ‘মসুলে ২০ লাখ মানুষের বাস। দু’হাজার মেয়েকে আটকে রেখেছিল জঙ্গিরা। মসুলের বাসিন্দারা কেউ এগিয়ে আসেননি তাদের উদ্ধারে। যারা এগিয়ে এসেছিলেন তারা হাজার হাজার ডলার দাবি করছিলেন। ’ বন্দি থাকাকালীন ইউরোপ, সৌদি আরব, তিউনিশিয়া থেকে একের পর এক জঙ্গি আসতো, আর নিয়মিত ধর্ষণ করত তাকে। ধর্ষণের আগে প্রার্থনাও করিয়ে নেয়া হতো।

তিনি বলেন, আমাদের জন্য, বিশেষ করে ইয়াজিদিদের জন্য, তারা (আইএস জঙ্গিরা) পুরুষদের হত্যা করছে এবং নারী ও শিশুদেরকে তাদের আস্তানায় নিয়ে যাচ্ছে। তারা ধর্মের নামে খুন, হত্যা, ধর্ষণ-সহ সব ধরনের অপরাধ করছে।

ইরাকের শিনজারে বেড়ে উঠেছেন নাদিয়া। এই শহরে বেশ কয়েকটি গণকবরের সন্ধান পাওয়া যায়। এসব গণকবর থেকে শতাধিক নারীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়; যাদের অধিকাংশই ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের নারী।






মতামত দিন।

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*