প্রাণের ৭১

সৃজনশীল পদ্ধতির জন্য বড় হুমকি নোট বা গাইড বই -মোহাম্মদ হাসান

  • সৃজনশীল পদ্ধতির জন্য বড় হুমকি নোট বা গাইড বই -মোহাম্মদ হাসান

নোট-গাইড শিক্ষার্থীদের মেধা, মনন, সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী শক্তি নষ্ট করে দিচ্ছে। শুধুমাত্র ব্যবসায়িক কারণে এখনো নোট-গাইড জোর করে চালানো হচ্ছে। এর সাথে বৃহৎ সিন্ডিকেট জড়িত। এখন জাতীয়ভাবে ভাবা উচিত যে, সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করার পরও এখনো নোট-গাইড চলছে কেমন করে।

সৃজনশীল প্রশ্ন চালু হয়েছে দশ বছর ধরে, শিক্ষার্থীর চিন্তাশক্তির বিকাশের জন্য। শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী হিসেবে অনেক বেশি আনন্দিত হয়েছিলাম, কিন্তু কী হচ্ছে সেখানে? আসলেই কি শিক্ষার্থীরা চিন্তাশক্তি বিকাশের সুযোগ পাচ্ছে বাজারে প্রচলিত গাইড বইগুলোর কারণে? পত্রিকার কল্যাণে এবং শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে জানতে পারলাম- অনেক স্কুলে তাদের পরীক্ষার প্রশ্ন হুবহু ছাপিয়ে দেয় সেই সব বাজারে প্রচলিত গাইড বই থেকে এবং শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের আগে থেকেই সেই সব গাইড বই কিনে পড়তে বলেন। তাহলে শিক্ষার্থীর চিন্তাশক্তির বিকাশ কীভাবে ঘটবে?

সৃজনশীল পদ্ধতির জন্য বড় হুমকি বিভিন্ন প্রকাশনীর নোট বা গাইড বই। অথচ প্রথম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তকের নোট বই মুদ্রণ, প্রকাশনা, আমদানি, বিতরণ ও বিক্রি নিষিদ্ধকরণের উদ্দেশ্যে প্রণীত ১৯৮০ সালের নোট বই নিষিদ্ধকরণ আইনের ৩ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি নোট বই মুদ্রণ, প্রকাশনা, আমদানি, বিক্রয়, বিতরণ অথবা কোনো প্রকারে উহার প্রচার করিতে বা মুদ্রণ, প্রকাশনা, বিক্রয়, বিতরণ কিংবা প্রচারের উদ্দেশ্যে রাখিতে পারিবেন না।’

এ আইন অমান্য করলে সর্বোচ্চ সাত বছরের সশ্রম কারাদ- অথবা ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদ- অথবা উভয় দ-ে দ-িত করার বিধান রাখা হয়েছে। পরে একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নোট বই নিষিদ্ধকরণ আইনের আওতায় নোট বইয়ের সঙ্গে গাইড বইও বাজারজাত এবং বিক্রি নিষিদ্ধ করেন হাইকোর্ট।

রাজধানীর বাংলাবাজারকেন্দ্রিক এসব প্রকাশক সৃজনশীল বই প্রকাশ না করলেও ‘সৃজনশীল গাইড বই’ প্রকাশে দারুণ মনোযোগী। আগে যেসব প্রকাশনী নোট বই ছাপতো, এখনো তারাই সৃজনশীল গাইড বই বাজারে ছাড়ে। আইনে নিম্ন মাধ্যমিক পর্যন্ত নোট বা গাইড বই নিষিদ্ধের কথা বলা আছে। এর আওতার বাইরে থেকে যাচ্ছে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের গাইড বই।

মানোন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য নিরন্তর রাজপথে থাকা জাতীয় শিক্ষাধারার মতো করে রাজপথকে শুধু রাজনীতির সূতিকাগার না করে শিক্ষা-সমাজ-সংস্কৃতি ও সভ্যতার জন্যও নিরন্তর এগিয়ে যেতে হবে।

প্রশাসন থেকে যদিও বলা হচ্ছে যে, ‘গাইড বই বিক্রি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে সরকার। আর কোনো শিক্ষক এর সঙ্গে জড়িত থাকলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তার পরও যারা বিক্রি করছেন, তাদের বিরুদ্ধে শিগগিরই ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য আমি উপর মহলকে জানিয়েছি। আমরা অতীতেও বিভিন্ন সময় এ বিষয়ে অভিযান চালিয়েছি। এবারও শিগগিরই গাইড ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’ কিন্তু তাদের এসব কথা কেবল দৈনিকের পাতায় প্রকাশিত সংবাদ আর বড় বড় বুলি পর্যন্তই শেষ। সেই সুযোগে গড়ে উঠেছে হাসান বুক ডিপো, জুপিটার গাইড, পাঞ্জেরী গাইড, পপি গাইড, নবযুগ গাইড ও লেকচার গাইডসহ শতাধিক প্রতিষ্ঠান। আর এ প্রতিষ্ঠানগুলো লোভের সর্বোচ্চ সীমায় চলে গেছে। এ প্রতিষ্ঠাগুলো ধর্ম ব্যবসার লেবাস লাগিয়ে একের পর অধর্মীয় কর্মকান্ড করেই যাচ্ছে। কখনো এরা তাবলিগি আলেম, কখনো পীরের মুরিদ সেজে ক্রমশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কমিশন দিয়ে নোট-গাইড তালিকাভুক্ত করে যাচ্ছে। শুধু এখানেই শেষ নয়; স্টেশনারি এবং বইয়ের দোকানগুলোতে নিষিদ্ধ গাইড ও নোট বইয়ের ছড়াছড়ি। আইনানুযায়ী বাজারজাত করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হলেও কমিশনে বিক্রি করা হচ্ছে গাইড ও নোট বই। অন্যদিকে নামিদামি স্কুল ও কলেজগুলোতে শিক্ষক এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে উপঢৌকন দিয়ে গাইড ও নোট বই তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে। অবশ্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় অনেক আগেই নোট ও গাইড বই নিষিদ্ধ করেছে। জাতির কল্যাণ বিবেচনায় নিয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালতও এ নিষেধাজ্ঞার পক্ষে রায় দিয়েছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও সারা দেশে দেদার বিক্রি হচ্ছে নোট ও গাইড বই। পুরান ঢাকার বাংলা বাজারের কিছু অসাধু প্রকাশনা সংস্থার মাধ্যমে এসব বই ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে। পৌঁছে যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের হাতে হাতে। এ অবস্থা বহু বছর ধরে চলে এলেও বন্ধ করতে কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। ফলে শিক্ষার্থীরা নোট ও গাইড বইনির্ভর হয়ে পড়েছে। এতে প্রকৃত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা আর লাভবান হচ্ছেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কিছু শিক্ষক ও অসাধু ব্যবসায়ী। এ অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সরকার বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। নোট-গাইডের ব্যবসা বন্ধে নজরদারির কথা জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি)। নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও নোট-গাইডের ব্যবসা কীভাবে চলছে, তার খোঁজ রাখে না এনসিটিবি। বাংলা বাজার থেকে এসব বই যাতে উৎপাদন ও

বাজারজাত হতে না পারে, এর ব্যবস্থাও নিচ্ছে না। ব্যবস্থা নিলে বাংলা বাজারের নোট-গাইড সারা দেশে সয়লাব হতো না। নীরব ঘাতক হিসেবে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাও ধ্বংসের হাত থেকে মুক্তি পেত।

প্রতিটি স্কুলের শিক্ষকরা যাতে সৃজনশীল প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করেন সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ এবং যাতে বাইরে থেকে প্রশ্নপত্র সংগ্রহ করতে না পারেন সে বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে চিঠি পাঠানোর সুপারিশ করা হয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের একাডেমিক সুপারভিশন প্রতিবেদনে। সৃজনশীল পদ্ধতির সব ধরনের গাইড বই নিষিদ্ধ করে নতুন করে আইন প্রণয়নও জরুরি হয়ে পড়েছে। তবে শুধু আইন করেই গাইড বই বন্ধ করা যাবে না। শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষকসহ সবার সচেতনতা জরুরি। নামকাওয়াস্তে নয়, শিক্ষকদের জন্য চাই কার্যকর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। শিক্ষকরা সৃজনশীল পদ্ধতি বুঝতে পারলেই ক্লাসে বোঝাতে পারবেন, প্রশ্ন তৈরি করতে পারবেন। তবেই বাজবে নোট-গাইড, কোচিং ও মুখস্থবিদ্যার বিদায়ঘণ্টা।

লেখকঃ মোহাম্মদ হাসান, সাংবাদিক,কলামিস্ট, পিএ সাবেক গণপূর্ত মন্ত্রী।






মতামত দিন।

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*