প্রাণের ৭১

হারিয়ে যাচ্ছে পাখি বাবুই পাখি ও তাদের নান্দনিক বাসা

আবহমান কাল থেকে গ্রাম বাংলার উচু তাল গাছে দল বেধে বাসা বা্েঁধ বাবুই পাখি। এখন আর তাল গাছে আগের মতো বাবুই পাখির নান্দনিক বাসা চোখে পড়ে না। কবির ভাষায় ‘তাল গাছ এক পায় দাড়িয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে’- আকাশ পানে তাকিয়ে থাকলেও গ্রাম বাংলায় হারিয়ে যাচ্ছে বাবুই পাখি ও তাদের শৈল্পিক সৃষ্টি বাসা। একদিকে গাছিরা বাঁশ বেধে তাল গাছের মোচা থেকে মিষ্টি রস আহরণসহ গাছ কেটে উজাড় করা,- শিকারীদের অত্যাচার , খাদ্যের অভাব সহ নানা কারনে এখন আর আগের মতো তাদের বাসা দেখতে পাওয়া যায় না। এভাবেই হারিযে যাচেছ শিল্পী পাখি বাবুই।
পাখি শুধু প্রকৃতির অলংকারই নয়, পাখি প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এক অতিপ্রয়োজনীয় প্রাণী। পাখিকে বাদ দিয়ে এই সবুজ পৃথিবী কল্পনা করা অসম্ভব। আমাদের দেশে নানা পাখির সমারোহ রয়েছে । এদের মধ্যে বাবুই পাখি একটি আলোচিত পাখি । বাবুই পাখি দেখতে স্ত্রী চড়–ই পাখির মত। গায়ের পালকের রঙ খয়েরি। বসন্ত ঋতুতে পুরুষ বাবুই দেখলে মনে হয় একটু সাজগোজ করেছে। মনে হয় যেন গায়ে হলুদ মেখে পালকগুলো হলুদ বানিয়েছে এবং গলায় গারো রঙ মেখেছে। স্ত্রী বাবুইদের রঙ কিন্তু কোন সময়েই বদলায় না। শীতকালে স্ত্রী ও পুরুষ বাবুইয়ের চেহারা একই রকম দেখতে। উপরের পালক লালচে হলুদ, তার ওপর কালচে পাটকিলের ছোটছোট টান। এই টান কোমরের কাছে এসে শেষ হয়েছে। ঘারে লালচে পালকসহ ডানা এবং লেজ গাঢ় পাটকিলে। চোখের উপরেও একটা টান। মাথা ও বুক একটু গাঢ় লালচে হলুদ। লম্বা ছয় ইঞ্চি।
বাবুই পাখির ইংরেজী নাম উইভার। বৈজ্ঞানিক নাম প্লাসিউস ফিলিপপিনাস। চড়–ই পাখিদের মত বাবুইরা ঘাসের বীজ ও শষ্যদানা খেয়ে পেট ভরে। ঠোঁটের গোড়ায় পোকা মাকড় পেলেও ছাড়ে না। ছানাদের শস্যের ক্ষতিকারক কিটপতঙ্গ খাইয়ে বড় করে।ফলে শস্য খেয়ে কৃষকের যেটুকু লোকসান করে তা শস্যের ক্ষতিকারক কীটপতঙ্গ মেরে ফেলায় পুরণ হয়ে যায়।
বাবুইকে অনেকে দেখে না চিনলেও বাবুই পাখির বাসা চেনে প্রায় সকল মানুষই। বসন্ত ঋতুতে পুরুষ বাবুই পাখি যখন হলুদ পোশাক গায়ে চাপায় তখন ছাড়া এদের দেখে মনে হয় বুঝি চড়–ই পাখির ঝাঁক। এ কারণেই মানুষের নজরে পড়ে না। ঘনজঙ্গল ওদের একদম অপছন্দের । ফসলের খেত, মাঠ অথবা একটু স্যাঁতসেঁতে জলাজমির ধারে বাবলা তাল, সুপারী খেজুর, ওমাদার গাছের উচু ডালে এরা বাসা বাঁধে। এ ছাড়া বাসা বাঁধে জলের ওপর যে গাছ ঝুলে পড়েছে সেই গাছে। না হয় যে গাছে কাঁটা আছে কিংবা সহজে যে গাছ বেয়ে ওঠে কারুর পক্ষে সম্ভব নয়। বাসা করতে পছন্দ করে সেই ডাল বা গাছ যেখানে হাওয়া বা ঝড়ের বেগ কম লাগে। বাসা দেখলে মনেহবে পাকা আবহাওয়া বিশারদের মত কাজ। যেদিক হতে বেশি ঝড় বা বাতাস বয়ে যাওয়া সম্ভব, এরা বাসার সরু মুখগুলোকে তার বিপরীত দিকে রাখে। তবে তাল গাছে বেশি বাসা বাধতে দেখা যায়।
বাবুইদের বাসা দেখতে যেন জল রাখার ছোট কুজোর মত। কুজোর গলা নিচের দিক করে ঝুলালে যে রকম দেখায়, বাবুইদের বাসা যেন সেই রকম। তাল, নারিকেল ও খেজুর গাছের কাশিল্পীর পক্ষে এই রকম নিপুণ কাজ অসম্ভব। বাসা তৈরির সময় গরমকাল থেকে বর্ষাকাল। এই সময় বাবুইরা মাঠে কিংবা জঙ্গলে গিয়ে ঠোঁট দিয়ে তাল-খেজুরের আঁশ যোগার করে আনে। এই আঁশ প্রথমে গাছের ডালে আটকিয়ে বাসা ঝুলাবার দড়ি তৈরি করে। দড়ি ঝুলানোর কাজ শেষ হলে বাবুইরা আসল বাসা বাঁধতে শুরু করে। প্রথমে বাসার চেহারা হয় দড়িতে ঝুলানো একটা ঘন্টা বা ছাতার মত। এই ঘন্টার নিচে এক গাছি শক্ত খড়ের দড়ি দাঁড়ের মত লাগানো দেখা যায়। বাবুইরা কাজের ফাঁকে ফাঁকে সেই ছাতার এলাকার দড়িতে ঝুলে বিশ্রাম করে এবং গান গেয়ে আনন্দ প্রকাশ করে। অনেকের ধারণা স্ত্রী বাবুই যখন মন দিয়ে বাসা বোনে, তখন মিয়া সাহেব দোল খেয়ে গান শুনিয়ে বউয়ের মন খুশি রাখে।
বাবুইরা ভারী ষ্ফূর্তিবাজ পাখি। বাসা তৈরি শেষ হয়ে গেলে এদের আনন্দের আর সীমা থাকে না। তখন তারা কি করবে ভেবে না পেয়ে উড়ে উড়ে শূন্যে ডিগবাজি খেতে আরম্ভ করে কখনও বা আনন্দে পরষ্পর কামড়া কামড়ি আরম্ভ করে। অন্য পাখিরা যেমন বাসায় যেতে প্রথমে উড়ে এসে বাসার কাছের একটি ডালে বসে এবং তারপর ধীরে সুস্থে বাসার ভিতর যায়। বাবুইরা তা করে না। এরা উড়তে উড়তে বাসার তলার শুঁড়ের মত পথ দিয়ে ভিতরে ঢুকে যায়। অন্য কোন পাখির পক্ষে এটা সম্ভব নয়।
কখনও কখনও বাবুই পাখি জোনাকী পোকা ধরে এনে ঘরে আলো জ্বালে । বাসা মনের মত না হলে নতুন বাসা তৈরি করে। বাবুইদের বাসা গাছ থেকে পড়ে গেলে, বাসার সরু খড়কুটো দিয়ে লোকে বালিশ তৈরি করে। এ বলিশ তুলো ভরা বালিশের মতই নরম হয়। স্ত্রীবাবুই পাখির আধিক্যের জন্যেই হয়ত বাবুই বংশ বিস্তা রক্ষা পায়। স্ত্রী বাবুই ডিম পাড়ে দুটি বা তিনটি। ডিমে তা দেয়া এবং ছানাদের যত্ন তাকেই করতে হয়।
মানুষের অত্যাচার আর অনাচার থেকে রক্ষাে পতে লোকালয় ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে দেখা যাচ্ছে অনেক বাবুইদের । বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন হিরণ পয়েন্টে ট্যুরিজম এলাকার প্রতিটি তালগাছে বাবুই পাখির শত শত বাসা রয়েছে। সেখানে নৌবাহিনী অফিসের বাঁ পাশের গেট দিয়ে মংলা বন্দর রেস্ট হাউজ এলাকায় ঢুকতে চোখে পড়ে তাল গাছের প্রতিটি পাতায় জড়িয়ে আছে বাবুই পাখির বাসা। এখানে নিরাপদ আশ্রয় মনে করে বাবুই পাখিরা বাসা বেধেছে বলে ধারণা করা হয়। এভাবেই চোখের আড়ালে চলে যাচেছ বাবুই পাখি।






মতামত দিন।

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*