কঠোর সমালোচনা ও প্রতিবাদের মুখে ধর্ষণদৃশ্য নিয়ে টিভি শো’তে মিশা-পুর্নিমার ‘হাস্যরস
![](https://www.praner71news.com/wp-content/uploads/2019/03/logo-71.png)
পুর্ণিমা কি কখনো ধর্ষণের শিকার হয়েছেন! কিভাবে তিনি নারী হয়ে ধর্ষণ নিয়ে হাসি তামাসায় মেতে উঠতে পারলেন? ধর্ষণ কি হাসি-ঠাট্টার বিষয়! সিনেমায় ধর্ষণ করতে কেমন মজা লাগে?
কাকে ধর্ষণ করতে ভালো লাগে-এরকম প্রশ্ন হাসতে হাসতে নায়িকা পূর্নিমা অবলীলায় করে ফেললেন আরটিভিতে প্রচারিত একটি অনুষ্ঠানে, যেনো ধর্ষণ তামশার বিষয়।
অভিব্যক্তি দেখে বোঝা গেল অনুষ্ঠানের অতিথি মিশা সওদাগরকেও মনে হলো এমন প্রশ্নে বেশ মজা পেয়েছেন। মিশা চাইলে সাবজেক্ট চেঞ্জ করতে পারতেন, করলেন না। নায়িকা পূর্ণিমা সিনেমায় মিথ্যা মিথ্যা ধর্ষিত হলেও, কখনো তাকে ছুঁতে পারেনি প্রকৃত ধর্ষিতার কান্না, হাহাকার। তার প্রশ্ন শুনে মনে হয়েছে এমন অভিনয় তাকে যৌন সুড়সুড়িই দিতো।
একজন নারী হয়েও ধর্ষষ নিয়ে তার এমন ঠাট্টামূলক প্রশ্ন অগ্রহণযোগ্য। টেলিভিশনের শো’তে এমন প্রশ্ন করায় তার ক্ষমা চাওয়া উচিত বলেই মনে করছেন সবাই। আমাদের মিডিয়ার তারকারা যেখানে ধর্ষণের বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন, সেখানে তাদের কেউ কেউ এ নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করছেন!
চিত্রনায়িকা পূর্ণিমা-মিশাকে নিয়ে ফেসবুকে চলছে তুমুল আলোচনা চিত্রনায়িকা পূর্ণিমাকে নিয়ে ফেসবুকে চলছে তুমুল আলোচনা। কেউ কেউ করছেন তুমুল সমালোচনাও।
প্রচারিত অনুষ্ঠানে এদিন মিশাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন ‘নির্যাতন দৃশ্যের শুটিংয়ে কোন নায়িকাকে আপনার পছন্দ’? প্রশ্নটি করা হয় বেসরকারী স্যাটেলাইট চ্যানেল আরটিভি’র ‘এবং পূর্ণিমা’ নামের একটি সেলিব্রিটি শো’তে।
এতে উপস্থাপিকা পূর্ণিমার প্রশ্ন, কার সাথে নির্যাতন দৃশ্যে অভিনয় করতে বেশী স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন আপনি?
প্রশ্নের উত্তরে মিশা সওদাগর জানান, ‘মৌসুমী ও পূর্ণিমার সাথে’ উপস্থাপিকা পূর্ণিমা হা হা হা করে হেসে ওঠেন।
অনুষ্ঠানের এই প্রশ্নটি নিয়েই চলছে আলোচনা সমালোচনা।
পূর্ণিমা বলছেন, প্রশ্নের পীঠে এমন প্রশ্নটি মূলত মজা করেই করা হয়েছে। কিন্তু ফেসবুকবাসী তো এটি মানতে নারাজ। তারা সমালোচনায় নেমেছেন আমাকে নিয়ে।
ওই অনুষ্ঠানে মিশা সওদাগরের নানা অজানা বিষয়ও উঠে এসেছে।
খলনায়ক হওয়ার পর কী কী সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন সেটিও জানিয়েছেন তিনি।
কোন তারকার সঙ্গে তার ভালো বন্ধুত্ব এবং চলচ্চিত্রের আজকের দিনে চিত্রনায়ক মান্না জীবিত থাকলে চলচ্চিত্র এমন অবস্থানে এসে দাঁড়াত না বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।
আরটিভিতে প্রচারিত হওয়া এ অনুষ্ঠানটি এখন ফেসবুকে ভাইরাল। সপ্তাহের প্রতি রোববার প্রচার হয় অনুষ্ঠানটি।
টিভিতে এ ধরণের কথোপকথন নিয়ে ফেসবুকে যারা সমালোচনা করছেন তাদের বক্তব্য – যে দেশে শিশুও ধর্ষণের শিকার হয় সেখানে ধর্ষণ নিয়ে আলাপে টেলিভিশনের পর্দায় হাস্যরস কেন?
অনেকে আবার এ প্রশ্নও তুলছেন – বাংলা চলচ্চিত্রে যৌন নিপীড়নের মতো ঘটনার এমন উপস্থাপনা কি সেগুলোকে স্বাভাবিক আচরণ হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে?
ফেসবুকে নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করে একজন লিখেছেন,
বাংলা সিনেমা সহ এই উপমহাদেশের সিনেমার একটা অতি পরিচিত ফর্মুলা আছে। কিছু নির্দিষ্ট দৃশ্য প্রচুর সিনেমায় ঘুরে ফিরে আসতে দেখা যায়। যেমন নায়িকা ও তার বান্ধবীদের পিছু নিয়ে গান গাইছেন নায়ক, কখনো সিটি দিচ্ছেন অথবা টিকা টিপ্পনী ছুড়ে দিচ্ছেন। সিনেমায় এটিকে নায়িকার মন ভোলানোর চেষ্টা হিসেবে দেখানো হলেও বাস্তব জীবনে এটি যৌন হেনস্থার সামিল।
একটি বেসরকারি টেলিভিশনের ঐ সাক্ষাৎকারটি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বেশ সোচ্চার হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরিন।
তিনি বলছেন, “পূর্ণিমা যে খুব স্বাভাবিক ভাবে অন্য আর যেকোনো প্রশ্নের মতোই কতবার ধর্ষণ করেছেন এই প্রশ্নটি করেছেন বা মিশা সওদাগরের সাথে যে এই বিষয়টি নিয়ে টেলিভিশন পর্দায় হাসাহাসি করেছেন, তার কারণ অধিকাংশ ছায়াছবিগুলোতে ধর্ষণ একটি বিনোদন দৃশ্য হিসেবেই উপস্থাপন করা হয়।”
“সিনেমায় ধর্ষণকে খুব স্বাভাবিক করে তোলার ফলে ধর্ষণের মতো অত্যন্ত একটা ভয়ঙ্কর অপরাধের প্রতিক্রিয়া দেখানোর ব্যাপারেও কিন্তু আমরা অসার হয়ে পড়ি।”
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নিয়ে গবেষণা করেছেন গীতি আরা নাসরিন। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে তার প্রতিক্রিয়ায় তিনি লিখছেন, “ফর্মুলা ফিল্মগুলোতে ধর্ষণ যতবার উপস্থিত হয়, তা গল্পের প্রয়োজনে নয়। ধর্ষণ উপযোগী করে চিত্রনাট্য রচিত হয়। তার সঙ্গে থাকে যৌন নিপীড়নের রোমান্টিকীকরণ।”
বাংলাদেশে সিনেমা হলে এমনকি যৌন নিপীড়নের দৃশ্যে দর্শকদের তালি বাজানো বা ইঙ্গিত মূলক কথাবার্তা পর্যন্ত বলতে দেখা যায়। গীতিআরা নাসরিন বলছেন সিনেমার এমন দৃশ্য ধর্ষণ বা যৌন নিপীড়নের প্রতি মানুষজনের সহনশীল মনোভাব তৈরি করছে।
তিনি বলছেন, “শুধু আইন দিয়ে প্রতিরোধ নয়, ধর্ষকের মনোভাব একটি সমাজে কিভাবে তৈরি হয় সেটিও খতিয়ে দেখতে হবে। সিনেমার মতো একটা অডিও ভিজুয়াল মাধ্যম মনোভাব সৃষ্টিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে…ধর্ষণের প্রতি সহনশীল মনোভাব কিভাবে সিনেমার মাধ্যমে তৈরি হচ্ছে এই আলোচনাটা এখন হওয়া অত্যন্ত জরুরী।”
তবে অধ্যাপক গীতিআরা নাসরিন বলছেন, বাংলাদেশে যৌন সহিংসতা একটা মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। সেই পরিস্থিতিতে সিনেমার পর্দায় ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের বাণিজ্যিক ব্যবহার নিয়ে আলাপের সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে পূর্ণিমা আর মিশা সওদাগরের কথোপকথন।
তার মতে, “সিনেমা জগতের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের দায়িত্ব এই দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা যৌন অপরাধের স্বাভাবিকীকরণকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। এ অবস্থার পরিবর্তনে কাজ করা, এ নিয়ে হাসাহাসি করা নয়।”
কিন্তু এমন দৃশ্য বাংলা সিনেমায় কিভাবে এলো?
বাংলা চলচ্চিত্রের পরিবেশক ও সিনেমা নিয়ে অনেক দিন ধরে সংবাদমাধ্যমে কাজ করছেন সৈকত সালাউদ্দিন। তিনি বলছেন, বাংলা সিনেমায় এমন দৃশ্যের ব্যাবহার শুরু ৮০’র দশকে হিন্দি সিনেমার অনুকরণে।
তিনি বলছেন, “এই বিষয়গুলো আমাদের সিনেমায় তখনই ঢুকেছে যখন আমাদের পাশের দেশের সিনেমাকে অন্ধ অনুকরণ শুরু হয়। হিন্দি সিনেমায় আশি ও নব্বইয়ের দশকে বেশ কিছু অপসিনেমা হয়েছে। সেগুলোকে নকল করার একটা ট্রেন্ড বাংলাদেশের সিনেমায়ও আসে।”
তিনি আরো জানান , “যারা নির্মাণ করছেন এটা তাদের রুচির অবক্ষয় কিন্তু আরো একটা প্রশ্ন তুলতে চাই সেটা হল বাংলাদেশের সেন্সর বোর্ড যখন অনেক বিষয়ে সতর্ক ও কঠোর তখন এধরনের দৃশ্য কিভাবে ছাড় পেয়েছে সেটি আমার কাছে অনেক বড় প্রশ্ন।”
বাংলাদেশের সিনেমার আর একটি নিয়মিত বিষয় হল – প্রেম। কিন্তু প্রেমের দৃশ্যে অনেক কিছুই এড়িয়ে যান বাংলাদেশের পরিচালকেরা। সেন্সর বোর্ডও নারী পুরুষের প্রেমের দৃশ্যে অনেক কঠোর।
যেখানে চুম্বনের দৃশ্য বাংলা সিনেমায় এখনো দেখানো হয় না সেখানে ধর্ষণের দৃশ্যে ভিলেন হিংস্র-ভাবে মেয়েটির শাড়ি খুলে ফেলছেন সেই দৃশ্য ঠিকই দেখা যায়। তার কারণ কি?
এ সম্পর্কে বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে পরিচালক মনতাজুর রহমান আকবর বলছেন, “ধর্ষণের দৃশ্য হলিউড, বলিউডে বা কলকাতায় আরো নেকেডভাবে দেখানো হয়। এটা বাণিজ্যিক চিন্তা করে করা হয়েছে। আবার চরিত্রের প্রয়োজনেও করা হয়েছে।”
তিনি আরো বলেন, “একজন পরিচালক হয়ত এমন সিন ব্যবহারের পর সেটি জনপ্রিয়তা পেয়েছে …আমাদের এখানে একজন আরেকজনকে দেখে কাজ করার প্রবণতা বেশী”।