ফর্সা হওয়ার হিড়িকে আবির্ভাব নতুন চর্মরোগের
![](https://www.praner71news.com/wp-content/uploads/2019/03/logo-71.png)
চলতি মাসের ২ তারিখ খবরের কাগজ খুলেই দেখি, ভোপালের এক স্কুলশিক্ষিকা মা তার কালো শিশুপুত্রকে ফর্সা করার জন্য গায়ে পাথর ঘষে ঘষে নির্মম ক্ষত করে দিয়েছেন শিশুর গায়ে! পরিণত বয়সে এক প্রতিষ্ঠিত মহিলাকে বলতে শুনেছিলাম, ‘জানেন, ছোটবেলায় এক টুকরো সাবান খেয়ে ফেলেছিলাম। কী করব? কালো বলে সবাই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করত! এক দিন পাশের বাড়ির কাকিমা বলেছিলেন, রোজ একটা করে সাবান খাবি, তা হলেই ফর্সা হবি’।
চর্মরোগের চিকিৎসক হিসেবে নিজের অভিজ্ঞতায় দেখি, প্রতিদিন বিভিন্ন বয়স ও বিভিন্ন পেশার মহিলা এসে বলেন, ‘‘এমনিতে কোনও সমস্যা নেই। ফর্সা হওয়ার ক্রিম লিখে দিন।’’ সবচেয়ে খারাপ লাগে যখন যে সব মহিলাদের গাত্রবর্ণ তাঁদের গোষ্ঠীসত্ত্বার পরিচায়ক, তাঁরাও একই দাবি নিয়ে আসেন!
এই হীনমন্যতার সংক্রমণের হাত থেকে ‘নার্সারি’র শিশুকন্যাও রেহাই পায় না—মায়ের কাছে ‘ফর্সা হওয়ার ক্রিম’ কিনে দেওয়ার জন্য বায়না ধরে। স্বল্প পারিশ্রমিক পাওয়া কিশোরী পরিচারিকা, অপুষ্টিতে ভোগা নিম্নবিত্ত ঘরের গৃহবধূরাও পয়সা বাঁচিয়ে একই ক্রিম কিনতে ছোটে। বিয়ের বাজারে আজও কালো মেয়ের জন্য পণের পাল্লা ভারী হয়। শহুরে, আলোকপ্রাপ্ত সমাজে মেয়েরা শিক্ষিত ও উপার্জনক্ষম হওয়ার জন্য বর্তমান চিত্র কিছুটা বদলালেও বিস্তীর্ণ নিম্নবিত্ত মেয়েরা একই অন্ধকারে রয়েছে। কেন এমন হল?
গায়ের রঙ কালো মানে তার ত্বকে ‘মেলানিন’ নামে রঞ্জক পদার্থ, যা ত্বকের বর্ণ নির্ধারণ করে—তা কিছু বেশি রয়েছে। আর এই ‘মেলানিন’ পৃথিবীর সমস্ত রৌদ্রপ্লাবিত অঞ্চলের মানুষের ত্বকে স্বাভাবিক সুরক্ষা আবরণের কাজ করে। যে কারণে কালো ত্বকের মানুষের শ্বেতাঙ্গদের চাইতে ত্বকের ক্যানসারের প্রবণতা অনেক কম।
ভারতে কালো-ফর্সার সমীকরণ গোলমেলে। আসলে সর্বকালে, সর্বদেশেই মানব সমাজে ক্ষমতার নির্ণায়ক বা শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় হিসেবে কোনও একটা ‘চিহ্ন’ (ফ্যাক্টর) খোঁজা হয়। ভারতে আর্য-দ্রাবিড় মিশ্র সভ্যতার দখলদারির সময় থেকেই সম্ভবত বর্ণবৈষম্যের বীজ রোপিত হয়েছিল। তবু মহাকাব্যে কৃষ্ণবর্ণা দ্রৌপদীকে নায়িকা বানাতে ব্যাসদেব দ্বিধাবোধ করেননি।
ভারতের উত্তর-পশ্চিম কোণ থেকে বার বার বিদেশি আক্রমণ ও উপনিবেশ স্থাপনের ফলে নিঃশব্দে ভারতীয়দের একাংশের বংশলতিকায় একটা বর্ণসঙ্কর তৈরির প্রক্রিয়া ঘটেছে বহু বছর ধরে। তারই পিছুপিছু এসেছে ‘ফর্সা মানে সুন্দর’ আর ‘কালো মানে অসুন্দর’—এমন আজব ধারণা। অথচ, কালো হয়ে জন্মানোর ‘অপরাধবোধ’ থেকে মুক্তি পেতে যে আত্মপ্রত্যয়ের প্রয়োজন সে শিক্ষা কোনও স্কুলে তো নয়ই, বেশিরভাগ পরিবারেও দেওয়া হয় না। তার উপরে ‘হা-রে-রে’ রবে তেড়ে এসেছে অজস্র বিজ্ঞাপন, যা সারাদিন ধরে হাতুড়ি ঠুকে ঠুকে তাদের সংস্থার লাভজনক কথাগুলো জনতার মস্তিষ্কে পাকাপাকি ভাবে পুঁতে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে—অমুক ক্রিম, তমুক সাবান না মাখলে ফর্সা হওয়া যাবে না। অথচ, বাজারে ফর্সা হবার ক্রিম বলে যা বিকোচ্ছে, তার মধ্যে থাকে কিছু অজানা রাসায়নিক, ‘ব্লিচিং এজেন্ট’, কিছু ভেষজ—যেগুলো ব্যবহার করলে ত্বক সাময়িক ভাবে কখনও উজ্জ্বল হয়, কখনও হয় না।
ত্বকের কিছু রোগের চিকিৎসার জন্য ‘স্টেরয়েড’যুক্ত মলম প্রয়োজন। ‘হাইড্রোকর্টিজোন’, ‘বিটামিথাজোন’, ‘মোমেটাজোন’, ‘হ্যালোবেটাসল’-এর মতো চর্মরোগের চিকিৎসায় বিভিন্ন ধরনের ক্ষমতাসম্পন্ন ‘স্টেরয়েড’ মলম রয়েছে। সর্বনাশ হল, যখন এদের কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াকে মানুষ ভুল ভাবে ব্যবহার করতে শুরু করল। ‘স্টেরয়েড’ মলম দীর্ঘদিন মুখে মাখলে ত্বকের ‘মেলানিন’ কমে যায়, ত্বক খুব পাতলা হয়ে যায়। ফলে, ওই অংশ সাময়িক ভাবে অপেক্ষাকৃত ফরসা লাগে। এই বার্তা ‘গণেশের দুধ খাওয়া’র মতো রটে গেল। বলা হল, ‘এগুলো মাখলে ফর্সা হওয়া যায়’।
স্টেরয়েড ব্যবহার শুরু করার প্রথম কিছু দিন সবাই খুব খুশি থাকে। মুখ, ফর্সা, মোলায়েম, চকচকে হয়ে ওঠে। উৎসাহিত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে নিয়মিত মলমটি ব্যবহার করেন অনেকে। তখনই ধরা পড়ে কুপ্রভাব। চামড়া পাতলা বা লালচে হয়ে যায়, লোম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায়, মুখভর্তি একই রকম ব্রন হয়, ত্বকের স্বাভাবিক আর্দ্রতা কমে যায়। তা ছাড়া, ‘স্টেরয়েড’ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে ত্বকের জীবাণু-বৃদ্ধিকে ত্বরাণ্বিত করে। ফলে, ব্রনগুলো পেকে পুঁজভর্তি ফোড়ার আকার নেয়। ‘স্টেরয়েড’ মলম ত্বকের মাধ্যমে রক্তে শোষিত হওয়ায় শরীরের অন্য জায়গাতেও এর ক্ষতিকারক লক্ষণ দেখা যায়। যেমন—চামড়ায় ফাটা দাগ। সব মিলিয়ে বিচ্ছিরি কাণ্ড।
দীর্ঘদিন ‘স্টেরয়েড’ মলম মাখার পরে যখন মাখা বন্ধ করার চেষ্টা করা হয় তখনও নানা রকম সমস্যা (উইথড্রয়াল সিম্পটমস) হয় বলে অনেকে ভাবেন, ‘ওই মলমটি মেখেই যাই না কেন’! তাতে ক্ষতির মাত্রা বাড়ে। এই সব লক্ষণগুলো মিলে এই ‘স্টেরয়েড’-মাখা জনিত সমস্যাটার চিকিৎসা পরিভাষায় নাম দেওয়া হয়েছে ‘টপিক্যাল স্টেরয়েড ডিপেন্ডেন্ট/ড্যামেজড ফেস’ (টি়এসডিএফ)। দীর্ঘদিন সমীক্ষা চালিয়ে এই সমস্যার নামকরণ (টি়এসডিএফ) করেছেন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কৌশিক লাহিড়ী, ২০০৮ সালে। কৌশিক লাহিড়ী ও অধ্যাপক-চিকিৎসক অরিজিৎ কুণ্ডু এই সমস্যার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পথিকৃৎ। ওঁরা দেশের বিভিন্ন জায়গায় ১২টি প্রতিষ্ঠানে এক বছর ধরে সমীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ করে দেখেছেন, ২৬২৯টি মুখের বিভিন্ন চর্মরোগের মধ্যে ‘টি়এসডিএফ’ রোগীর সংখ্যা ৪৩৩ বা ১৪.৩৩ শতাংশ, যা নগণ্য নয়।
২০০৯ সালে ‘টি়এসডিএফ’-এর সমস্যা পাকাপাকি ভাবে চর্মরোগ বিজ্ঞানে নথিভুক্ত হয়। এর পরে ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অব ডার্মাটোলজি, ভেনেরিওলজি অ্যান্ড লেপ্রোলজি’-র তরফ থেকে বিভিন্ন উদ্যোগ হয়েছে ও ক্রমাগত চেষ্টা চলছে সচেতনতা বৃদ্ধি ও কিছু ওষুধ নিষিদ্ধ করার, যাতে ‘টি়এসডিএফ’-কে নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। এ নিয়ে চিকিৎসা জগতে প্রচুর আলোচনা, লেখালেখিও হচ্ছে। কিন্তু ‘স্টেরয়েড’ এক মোড়কের বদলে অন্য মোড়কে বিক্রি হচ্ছে। মানুষও দেদার কিনছে।
শুধু মানুষের ফর্সা হওয়ার প্রবল ইচ্ছের জন্য চিকিৎসাশাস্ত্রের অভিধানে একটা নতুন অসুখ সংযোজিত হল, যার প্রতিষেধক
শুধুই সচেতনতা!