প্রাণের ৭১

ধর্মীয় উগ্রপন্থার উত্থান: ভয়াবহ পরিণতির আশঙ্কা-জি এম কাদের

জীবিকার সন্ধানে বাংলাদেশের মানুষ এখন বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছে। সম্প্রতি পাকিস্তানে এক সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে দুই বাংলাদেশি নিহত হয়েছে বলে খবরে প্রকাশিত হয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধেও রাশিয়ার হয়ে ভাড়াটে যোদ্ধা হিসেবে লড়াইরত দুই বাংলাদেশির পরিচয় পাওয়া গিয়েছে—একজন নিহত হয়েছেন, অন্যজন বেঁচে আছেন।

অর্থায়ন ও পৃষ্ঠপোষকতা পেলে বিপুল সংখ্যক দরিদ্র ও ধর্মানুরাগী জনসংখ্যার এই দেশ গোটা বিশ্বের জন্য ‘জঙ্গি’ ও ‘আত্মঘাতী হামলাকারী’ উৎপাদনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হওয়ার ঝুঁকি এড়িয়ে যাওয়া যাচ্ছে না।

বাংলাদেশ কি তবে সহিষ্ণু, অসাম্প্রদায়িক, উদার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র থেকে একটি সাম্প্রদায়িক ‘ইসলামি রাষ্ট্রের’ দিকে ধাবিত হচ্ছে? এ প্রশ্ন এখন দেশের সচেতন নাগরিকদের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদেরও উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।

ছাত্র আন্দোলন থেকে গণ-অভ্যুত্থান

২০২৪ সালের জুলাইয়ের শুরুতে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবি নিয়ে ছাত্রদের আন্দোলন শুরু হয়, যা দ্রুতই দেশব্যাপী বৈষম্যবিরোধী গণ-আন্দোলনে রূপ নেয়। বয়স, রাজনৈতিক অবস্থান নির্বিশেষে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ এতে যোগ দেয়। আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীরা অহিংস থেকে সশস্ত্র হামলার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।

৫ আগস্ট ২০২৪ আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে এ আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে। পরে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। সরকার প্রধান প্রকাশ্যেই আন্দোলনের ছাত্রনেতাদের নতুন প্রশাসনের “নিয়োগদাতা কর্তৃপক্ষ” ও অভিভাবক হিসেবে ঘোষণা দেন। তাদের কাউকে কাউকে মন্ত্রিসভায় এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা, পরামর্শক বা তদারকির দায়িত্বে নিয়োগ প্রদান করা হয়। যার ফলে, তরুণ ছাত্র আন্দোলনকারীদের একটা অংশ রাষ্ট্রের অলিখিত অভিভাবক হয়ে ওঠেন। এমনকি প্রধান উপদেষ্টা এই গণ-আন্দোলনকে “meticulously designed” বলে আখ্যায়িত করেন।

চলমান বয়ানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও তরুণ নেতৃত্ব পূর্ববর্তী সরকার কর্তৃক নিপীড়নের শিকার সবাইকে দেশপ্রেমিক আর বাকি সবাইকে “ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের” সহযোগী হিসেবে চিহ্নিত করতে থাকে।

ধর্মীয় উগ্রপন্থার সুযোগ সৃষ্টি

শেখ হাসিনার আমলে কঠোর নিরাপত্তা অভিযানে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো কোণঠাসা ছিল। তারা ছিল হাসিনা সরকারের সবচেয়ে কঠোর বিরোধীপক্ষের মধ্যে অন্যতম। সাম্প্রতিক প্রতিবেদনগুলো থেকে স্পষ্ট যে বিগত শাসনব্যবস্থার পতনে এসব গোষ্ঠী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কয়েকটি গোষ্ঠী আন্দোলন চলাকালে সহিংসতা ও নাশকতায় জড়িত থাকার কথা প্রকাশ্যে স্বীকারও করেছে। তাদের কেউ কেউ সংবিধান পুনর্লিখন করে এবং বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের বিভিন্ন উপাদান মুছে দিয়ে একটি ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে অবস্থান পরিষ্কার করেছে।

আমরা স্মরণ করতে পারি, আন্দোলন চলাকালে এবং গণঅভ্যুত্থানের পরে রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য শহরের দেয়ালজুড়ে হিজবুত তাহরীর ও আইএস-সদৃশ পতাকা, স্লোগান ও আরবি লিপি দেখা গেছে।

আন্দোলনের সমন্বয়কারীদের মধ্যে কেউ কেউ এসব গোষ্ঠীর প্রতি নানাভাবে তাদের সংহতি প্রকাশ করেছে। তাদের অভিন্ন লক্ষ্য ছিল, আওয়ামী লীগ সরকারকে অপসারণ এবং ইসলামপন্থি একটি রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠা। মার্কিন গোয়েন্দা প্রধান তুলসী গ্যাবার্ড বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান নিয়ে সতর্ক না করা পর্যন্ত ওদের কার্যকলাপকে ‘দেশপ্রেমিক’ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছিল এবং প্রকাশ্যেই তারা দেশবিরোধী কর্মকাণ্ড প্রচার করে যাচ্ছিল। এর পরপরই, ১ এপ্রিল ২০২৫, নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ “বাংলাদেশ বিনির্মাণকে সুযোগ হিসেবে দেখছে কট্টর ইসলামপন্থিরা”(As Bangladesh Reinvents Itself, Islamic Hardlines See an Opening) শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক চাপের মুখে তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাদের প্রকাশ্য কর্মকাণ্ড সীমিত করে দিলেও ভিন্নরূপে তাদের কর্মকাণ্ড অব্যাহত থাকে।

নতুন রাষ্ট্রকাঠামো তৈরির চাপ

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়া সাধারণ মানুষ চেয়েছিল সুষ্ঠু নির্বাচন, জবাবদিহিমূলক সরকার ও বৈষম্যহীন সমাজ। কিন্তু আন্দোলনের সমন্বয়কারীদের মধ্যে কেউ কেউ তাদের লক্ষ্যকে শুধু নির্বাচনি সংস্কারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেননি, তারা “নয়া বন্দোবস্তের” নামে পুরোপুরি একটি নতুন রাষ্ট্রকাঠামো গঠনের কথা বলতে শুরু করেন— যার রূপরেখা অনেকটা পাকিস্তান আমলের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পুনরাবৃত্তির মতো শোনায়। তাদের কয়েকজনের বয়ানে মুক্তিযুদ্ধকে ‘বিদেশি চক্রান্ত’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়, মুক্তিযোদ্ধাদের বিশ্বাসঘাতক বলা হয়, এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে একটি ঐতিহাসিক ভুল হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।

এখন এটা স্পষ্ট যে জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির জুলাই আন্দোলনের ভেতর গভীরভাবে সক্রিয় ছিল।

আন্দোলনের বহু সমন্বয়কারীর ব্যাকগ্রাউন্ডে দেখা যায়, তারা ইসলামপন্থি মতাদর্শে বেড়ে উঠেছেন এবং গোপনে জামায়াত–শিবিরের নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

আন্দোলনের নেতারা অতীতের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ও তাদের মতাদর্শিক লক্ষ্যগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কাঠামোগত সংস্কারের দাবিও তুলেছেন। এসব লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্যে জামায়াত–নিয়ন্ত্রিত সাম্প্রদায়িক ও উগ্রপন্থি শক্তিগুলো এখন রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বলে মনে হচ্ছে—হোক তা সরাসরি, বা তাদের অনুকূলে সাজানো একটি প্রহসনমূলক নির্বাচনের পথ ধরে।

রাষ্ট্রক্ষমতার জন্য প্রহসনমূলক নির্বাচন

অন্তর্বর্তী সরকার অভ্যুত্থানের সময় গড়ে ওঠা জাতীয় ঐক্যকে ভেঙে দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলকে দুই মেরুতে বিভক্ত করেছে—একদিকে ব্যাপক জনসমর্থনসম্পন্ন উদারপন্থি ও মধ্যপন্থি রাজনৈতিক দলগুলো এবং বিপরীতে, রক্ষণশীল বা কট্টর ইসলামপন্থি গোষ্ঠীগুলো।

উদারপন্থি শক্তিগুলোকে “ফ্যাসিস্টের দোসর” আখ্যা দিয়ে তাদের রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এমনকি মানবাধিকার পর্যন্ত কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।

গত ১২ মে ২০২৫ প্রশাসনিক আদেশে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের মিত্ররা জাতীয় পার্টি (জাপা) ও ১৪-দলীয় জোটকেও নিষিদ্ধ করার পরিকল্পনা করছে। এমনকি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অনুমতি দিলেও সরকার সমর্থিত বাধা, সহিংসতা এবং অসম প্রতিযোগিতামূলক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে জাপাকে প্রতিকূল পরিবেশের মুখোমুখি করা হচ্ছে।

এর ফলে এমন একটি রাজনৈতিক বন্দোবস্ত গড়ে উঠছে, যেখানে নির্বাচন কার্যত দাঁড়াবে; একপক্ষ জামায়েত ও তার মিত্ররা অর্থাৎ যে পক্ষ সরাসরি অন্তর্বর্তী সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করছে ও অন্য পক্ষ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। অথচ বিগত ভোটের হিসাব অনুযায়ী, এই দুই গোষ্ঠী মিলেও মোট ভোটারের সর্বোচ্চ অর্ধেকের প্রতিনিধিত্ব করে।

ভোট কেনার জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় করা এবং প্রশিক্ষিত ক্যাডার ব্যবহার করে প্রতিপক্ষকে ভয়ভীতি প্রদর্শনের ব্যাপারে জামায়াতের বিরুদ্ধে অসংখ্য প্রতিবেদন রয়েছে। পর্যবেক্ষকদের মতে, অন্তর্বর্তী সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় জামায়াত প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিচারব্যবস্থা ও নির্বাচন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।

গত ২২ নভেম্বর চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত এক সমাবেশে জামায়াতের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শাহজাহান চৌধুরী বলেন, ‘নির্বাচন শুধু জনগণ দিয়ে নয়… যার যার নির্বাচনি এলাকায় প্রশাসনের যারা আছে, তাদের সবাইকে আমাদের আন্ডারে নিয়ে আসতে হবে। আমাদের কথায় উঠবে, আমাদের কথায় বসবে, আমাদের কথায় গ্রেফতার করবে, আমাদের কথায় মামলা করবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘পুলিশকে আপনার পেছনে পেছনে হাঁটতে হবে। ওসি সাহেব আপনার কী প্রোগ্রাম, তা সকালবেলায় জেনে নেবেন আর আপনাকে প্রটোকল দেবেন।’

ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (IRI)-এর সাম্প্রতিক এক জরিপ বলছে, আগামী সপ্তাহে যদি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তবে বিএনপি পাবে ৩০ শতাংশ ভোট এবং জামায়াতে ইসলামী পাবে ২৬ শতাংশ। জরিপে আরও দেখা যায়, ৫৩ শতাংশ উত্তরদাতা জামায়াত ইসলামী সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন, যা বিএনপির ৫১ শতাংশের তুলনায় সামান্য বেশি। এদিকে ৭ শতাংশ ভোটার এখনও সিদ্ধান্তহীন, আর ১১ শতাংশ তাদের পছন্দ জানাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, আওয়ামী লীগ ও ১৪-দলীয় জোট এবং জাতীয় পার্টি (জাপা) নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সুযোগ না পেলে, জামায়াত ও তার মিত্ররা একপাক্ষিক নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে পারে।

ইসলামপন্থি শাসনব্যবস্থার ঝুঁকি

বাংলাদেশ ১৭ কোটি জনসংখ্যার একটি ঘনবসতিপূর্ণ ও স্বল্প সম্পদের দেশ, যার প্রায় ৯০ শতাংশ জনগণ মুসলমান। ঊর্বর ভূমিই এ দেশের প্রধান সম্পদ। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রায় ৩৯ মিলিয়ন মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। এর মধ্যে ১৫.৮ মিলিয়ন চরম দারিদ্র্যের মধ্যে রয়েছে। একদিকে সীমিত কর্মসংস্থান, অন্যদিকে উচ্চহারে বেকারত্ব। ফলে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষ কাজের সন্ধানে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। বিপজ্জনক ও অবৈধ পথ অবলম্বন করতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকে।

অর্থায়ন ও মতাদর্শিক পৃষ্ঠপোষকতা পেলে, বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক অর্থনৈতিকভাবে দুর্দশাগ্রস্ত ধর্মপ্রাণ তরুণ জনগোষ্ঠী উগ্রবাদী নেটওয়ার্কগুলোর জন্য বিপুল নিয়োগ-ভান্ডারে পরিণত হতে পারে। সাম্প্রদায়িক ইসলামি দল ও সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো রাষ্ট্রক্ষমতায় এলে তা শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, বৈশ্বিক নিরাপত্তার জন্যও ভয়াবহ হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।

লেখক: জি এম কাদের চেয়ারম্যান, জাতীয় পার্টি






মতামত দিন।

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*