প্রাণের ৭১

অর্থ দু’দিনে চলে যায়। কিন্তু কাজ থেকে যায়। এইটুকু তো আমাদের বুঝতে হবে

এসব দেখলে নিজেকে বড় একা আর অসহায় লাগে। তাই এসব বিষয়ে সহজে কোনও মন্তব্য করি না। কারণ, আমার মন্তব্য কারোর ভালো লাগবে না। করোরই না। তাই যতক্ষণ সম্ভব চুপ থাকি। নিজে নিজে পুড়ি। সেই ভালো।

সারা দুনিয়ায় চলছে মহামারি আর মৃত্যুর মিছিল। আর আমার অনুজরা সেই সময়ে জোট করছে টাকা-পয়সার হিসাব নিয়ে। যেন সম্মানটা গৌণ, সম্মানীটাই মুখ্য। যেখানে শিল্প আর শিল্পী সত্তা নিয়ে টুঁ শব্দটি নেই, আছে সম্মানী তোলার চিৎকার।

শিল্পীরা পয়সা ছাড়া গাইবে না, ভালো কথা। তো সেটার জন্য জোট করে ঢোল পিটিয়ে বলতে হবে কেন! এটা নিয়ে স্টেটমেন্ট দেওয়ার কিছু নেই তো।

পয়সার বিনিময়ে আমি একটা শোতে গান করবো, নাকি পয়সা দিয়ে কোনও বিশেষ অনুষ্ঠানে নিজেকে তুলে ধরবো, সেটা তো একজন শিল্পীর ব্যক্তিগত অভিরুচির বিষয়। সেই প্রশ্নটা বা সিদ্ধান্তটা কিন্তু কেউ তোলেনি। একজন শিল্পীর ভেতরে যদি সত্যিকারের শৈল্পিক বিষয়টা থাকে, সেখানে অর্থটা বড় বিষয় না। সেখানে সম্মানটা বড় বিষয়। তারপর অর্থ।

 

আমি যত ছোট বা অ-জনপ্রিয় শিল্পীই হই না কেন, নিজের সম্মান বা ব্যক্তিত্বটা অর্থ দিয়ে বিবেচনা করবো না। যেখানে আমার সম্মানটা থাকবে, সেখানে দরকার হলে আমি ফ্রি গান করবো। সমস্যা নেই তো। এখনও আমি কুমার বিশ্বজিৎ অনেক কাজ করি, সম্মানী ছাড়া। আবার যেখানে আমার সম্মান থাকবে না, সত্তা থাকবে না, সেখানে তো টাকার বস্তা দিলেও যাবো না।

 

 

এই বিষয়টি হঠাৎ চোখে পড়ার পর আমি জাস্ট বোবা হয়ে গেলাম। মনে হলো, এরা কী করছে এসব! আবার এটুকুও বলতে চাই, এই যে শতাধিক ছেলেমেয়ে এক হয়েছে, একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, হোক সেটা ভুল সিদ্ধান্ত। সেটা আমার ভালো লেগেছে। এই যে তারা এক হতে পেরেছে, এটাকে আমি সাধুবাদ জানাই। এই ইউনিটির দরকার আছে।

কিন্তু যে বিষয়টা নিয়ে এক হয়েছে ‘টাকা না দিলে গান গাবো না’—এটা টোটালি বাজে কনসেপ্ট। এটার জন্য আসলে একত্রিত হওয়ার কিছু নেই। মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে আরও ১০১টা জরুরি ইস্যু আছে, যেগুলো নিয়ে এক হওয়ার দরকার আগেও ছিল, এখনও আছে। সেগুলো নিয়ে আমাদের কোনও জোট হয় না। প্রতিবাদ হয় না। কে কোথায় কীভাবে গাইবে, সেটা তো যার যার ব্যক্তিগত বিষয়। এখানে যারা আছে, তারা প্রত্যেকে আঠারো প্লাস। সবাই সব বোঝে। সে কার শো করবে, কোন শো করবে না, প্রত্যেকে ভালো বোঝে। আমার চেয়েও ভালো বোঝার লোক আছে এদের মধ্যে। তাহলে এই ইস্যুতে জোট করার কী আছে?

 

এবার একটু পেছনে যাই। এরা যে প্রতিদিন টিভি স্টেশনে গিয়ে লাইভ শো করে, কোনোদিন দুইটা শিল্পী এক হয়ে বলেছে, ‘আমাদের সম্মানী বাড়াও। না বাড়ালে আমরা আর তোমাদের শো করবো না।’ এই কথাটা যদি বলতো, তিন দিনের মধ্যে টিভি চ্যানেলগুলো টাকা বাড়াতে বাধ্য হতো। কারণ, প্রতিটা শো স্পন্সর নেওয়া। প্রতিটা শোয়ের ডিউরেশন এক থেকে তিন ঘণ্টা। শিল্পীরা যদি সারারাত জেগে ওই শোগুলো না করে, এই তিনটা ঘণ্টা কী দিয়ে ভরবে টিভি চ্যানেল? এই টিভি লাইভগুলো আমাদের শিল্পীদের সম্মানী এক টানে মাটিতে নামিয়ে দিয়েছে। এই চিন্তা আমরা আজ পর্যন্ত কেউ করেছি? কথা বলেছি কেউ? বলিনি। উল্টো, আমরাই টিভি স্টেশনে গিয়ে লাইন ধরেছি, ‘ভাই আমারে একটা শো দেন না…’ বলে।

এটা আমাদের বেসিক জায়গা ছিল, যেটার কারণে মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি অথবা শো ইন্ডাস্ট্রি ভয়ংকর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অথচ সেসব শো বছরের পর বছর তারা নামমাত্র সম্মানীতে করে গেছে। ওটা সম্মানীও না, চা-নাস্তার পয়সা। কথায় কথা বাড়ে। এবার আরও একটু পেছনে যাই। তারও আগে এই মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিটাকে খেয়েছে এফএম রেডিওগুলো। রেডিওতে গিয়ে আমরা নিজেদের মাস্টার নিয়ে লাইন ধরে বসে থাকতাম, ‘ভাই আমার গানটা চালাও চালাও চালাও…। ভাই এই গানটা শুধু তোমার স্টেশনের জন্য বানিয়েছি, বড় যত্ন করে। একটু চালাও।’ কারণ, আমরা ধরে নিয়েছি এফএম রেডিওতে আমার গানটা চলা মানেই স্টার হয়ে যাওয়া। তো এখন এই মহামারির মধ্যে সেই তুমিই ‘সম্মানী’র দাবি তুলেছো কার বরাবর? সেসময় আমরা এক হতে পারিনি। কথা বলতে পারিনি। আর যে সেলেবল, তাকে চিৎকার করে বলতে হবে না, টাকা না দিলে আমি গাইবো না। তোমরা এই স্টেটমেন্ট দেওয়ার মানেটাই হলো—তোমরা সেলেবল না।

মূল কথাটা বলি। একজন শিল্পীকে আসলে আরও গভীরে ভাবতে হবে। যদি সে সত্যিকারের শিল্পী হয়ে থাকে। শিল্পী শব্দটি যদিও আজ ‘সম্মানী’র স্টেটমেন্টে ঢুকে গেছে, বাস্তবে তো তা না। শিল্পী বা শিল্পকে তো টাকা বা সম্মানী দিয়ে কেনা-বেচার সুযোগ নেই।

 

সবসময় তো পয়সার চিন্তা করলে হবে না। আমাকে প্রতিটা ধাপে একটু হিসেব করতে হবে। পয়সা পেলেই তো সবখানে আমি যাবো না। যদি যাই, তাহলে আমি শিল্পী না। শিল্পী হতে হলে, আত্মসম্মানবোধটা বাঁচিয়ে রাখতে হবে। সোজা কথা। প্রয়োজন হলে নিজের পকেটের টাকা খরচ করেও সেখানে যাবো, যেখানে আমি আমার শিল্পী সত্তার সম্মানটুকু পাবো।

 

গত সপ্তাহের একটা ঘটনা বলি। একটা নতুন টেলিফোন সেট লঞ্চ হচ্ছে। তো ওরা আমাকে বললো, ‘দাদা তিনটা গান করবেন। বাইরে শুটিং সেট ফেলবো। গাইবেন, ফাঁকে ফাঁকে টেলিফোন দিয়ে কথা বলবেন। কাজটা আপনাকে নিয়ে আমরা করতে চাই। আমরা চাই আপনাকে দিয়েই আমরা শুরু করি।’ প্রথমেই বললাম, ‘এই করোনার মধ্যে আমি ঘরের বাইরে যাবো না।’ আমার মূল উদ্দেশ্য, কাজটা করবো না। কারণ, নিজে গান গাইবো, সেটার ফাঁকে আবার ফোন কানে দিয়ে কথা বলবো। সেটা আবার কেটে কেটে বিজ্ঞাপন আকারে বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় চালাবে। বিষয়টি আমার কাছে একটু অস্বস্তি লাগলো। কিন্তু ফোন ওয়ালারা তো ছাড়ছে না। বললো, ‘ওকে দাদা, টেনশন নেবেন না। আমরা আপনার বাসাতেই আয়োজন করছি। একজন ক্যামেরাম্যান আসবে। সব রকমের স্বাস্থ্যবিধি মেনেই কাজটা আমরা করবো।’

 

এবার তো পড়লাম বিপদে। ভাবলাম, কাজটা করলে আমার শ্রোতা বা জুনিয়ররা কী ভাববে। বলবে, ‘উনি গানের ভেতরে টেলিফোনের বিজনেসও করছেন!’ জিংগেল হলেও সমস্যা ছিল না। পুরো মৌলিক গান, তার সঙ্গে আমার উপস্থিতি। এসব মিলিয়ে আমার মন টানলো না। কারণ, নিজের কণ্ঠ বা গানের সঙ্গে তো চতুরতা ঠিক নয়। কায়দা করে এমন সম্মানী চাইলাম, যেন তারা দৌড়ে পালায়। এমন অভিজ্ঞতা হাজার হাজার আছে। যেটা করবো না, সেটা তো সরাসরি মানা করা ঠিক না। কারণ, মানুষ তো আসলে ভালোবেসেই আসে আমাদের কাছে।

 

সম্মানী হাঁকিয়েও কাজ হলো না। তারা সেটিতেই রাজি। কী এক বিপদে পড়লাম, এই করোনার মধ্যে! এরপর নিরুপায় হয়ে সরাসরি সরি বললাম। বুঝিয়ে বললাম, এভাবে আসলে আমি নিজেকে দাঁড় করাতে পারবো না। মনের সঙ্গে বিরোধ রেখে আমি কিছু করতে চাই না। কাজটা করিনি। কত বড় টাকার কাজ, সেটা আর বললাম না। এখন অনেকই বলবেন, আমার তো অভাব নেই। আমি টাকার বিছানায় ঘুমাই! শুধু এটুকু বলি, টাকার ক্ষুধা পৃথিবীর প্রতিটি মানুষেরই থাকে। আমারও আছে, তবে সেটি কোনোভাবেই শিল্পের ক্ষুধার চেয়ে বেশি নয়। এখানেই একজন শিল্পী অন্য দশজন থেকে আলাদা। এজন্যই একজন শিল্পী পুড়তে পুড়তে একটা সময় সোনায় পরিণত হয়। আমি এখনও সেই সোনার সন্ধানেই আছি, টাকা নয়।

আমার একটা কথাই বারবার মনে হয়—সারাজীবন ধ্যান, জ্ঞান, শ্রম, মেধা ব্যয় করে মানুষের কিছু ভালোবাসা পেয়েছি। সেটাকে তো টাকার লোভে শেষ করা যাবে না। টাকা অনেক দেখেছি, বেঁচে থাকলে সামনেও দেখবো। কিন্তু ভুল করা যাবে না। শিল্পী সত্তাটাকে বেচে দেওয়া যাবে না। ওটাই আমার একমাত্র সম্বল।

এই যে এখন কথায় কথায় শুনি, ওদের কষ্টের কথা, স্ট্রাগলের কথা। কিন্তু আমরা যে পথটা পাড়ি দিয়েছি এই মিউজিকের জন্য—তার চেয়ে দুর্গম তো আর কিছু হতে পারে না। বাচ্চু (আইয়ুব বাচ্চু) মারা যাওয়ার পরদিন বাংলা ট্রিবিউনেই আমি স্মৃতি থেকে বলেছি, দুই বন্ধু চট্টগ্রাম থেকে চুরি করে ঢাকায় এসেছি একটি অডিশনে। ফেরার ভাড়া নেই। দুপুরে খাবো, দুজনের পকেটে মনে হয় ১০ টাকা ছিল। হোটেল থেকে সেই টাকাটা দিয়ে কাগজের প্যাকেটে করে ৫ টাকার ভাজি আর দুইটা পরোটা এনেছি। প্যাকেট থেকে পরোটা বের করতে গিয়ে ভাজি পড়ে গেলো মাটিতে। সেই ভাজি তুলে দুই বন্ধু পেট ভরে খেয়েছি। একজন আইয়ুব বাচ্চু আজ নাই, তার মতো এমন কয়েকটা মানুষের বুকের ওপর দাঁড়িয়ে আছে এই দেশের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি। এগুলো আমাদের ভুলে গেলে চলবে না তো। তাদের চেয়ে বড় স্ট্রাগল তো এই মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে পরের জেনারেশনের আর কেউ করেনি। ফলে টাকা বা সম্মানীর তাড়না তো আমাদের চেয়ে আর কেউ বেশি বোঝার কথা না।

 

আজ একা একা এসব তামাশা দেখি আর চিৎকার করি নিজে নিজে। একটা একটা করে অতীতের কথা মনে পড়ে। এই শরীরের প্রতিটা হাড়ে দাগ পড়ে গেছে, হেঁটে গ্রামের পর গ্রাম ইনস্ট্রুমেন্ট টানতে টানতে।

 

আবারও বলছি, এটা সৃষ্টিশীল মাধ্যম। এখানে সম্মানী ফ্যাক্টর নয়, সম্মানটা আসল। আমি যে কয়টা টিভিসি করেছি, সেটা নিজের পারসোনালিটির সঙ্গে গেছে বলে করেছি। তাও অনেক আগে। টাকার হিসাব করিনি। টাকা চাইলে তো বাপের ব্যবসাই করতাম। সেটা করলে তো আমার নামের আগে এখন ধনকুবের লিখতে হতো! এই সম্ভাবনা তো উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কিন্তু সেটা করিনি তো। সেই ছোটবেলা থেকে, আমার মা কথায় কথায় বলতো—‘বাবা গানের পয়সা পানেও হয় না।’ মানে গান গেয়ে পান কেনার পয়সাটাও হবে না। এসব পাগলামি ছাড়। ছাড়িনি। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও সবার অবাধ্য হয়ে ঘর ছেড়েছি। দিনের পর দিন না খেয়ে এই শহরে কাটিয়েছি। কিন্তু কমপ্রোমাইজ করিনি। সংগীত ছাড়িনি।

 

শুধু এটাই ভরসা ছিল মনে, যোগ্য হতে পারলে টাকা আমাকে খুঁজে নেবে, আর আমি খুঁজবো গানটাকে।

 

একজীবনে আমি যে ওদের মতো ভুল করিনি, সেটাও না। আমি সেই ভুলের যাতনা আজও বয়ে বেড়াই একা একা। এই কষ্টের কথা বলার লোক খুঁজে পাই না। এমন কিছু গান আমাকে করতে হয়েছে পরিস্থিতির শিকার হয়ে, যেগুলো এখনও আমার কাছে দুঃস্বপ্নের মতো লাগে। সেই গানের স্মৃতি বা সেইসব গান কানে এলে এখনও আমি দুই তিন রাত ঘুমাতে পারি না। সারারাত বিছানায় ওলট-পালট করি। আর আফসোস করি, ‘ইশ এই গানটা যদি আমি না গাইতাম। ইশ কেন গাইলাম?’

অথচ সেই গানগুলো আমাকে করতে হয়েছে বাধ্য হয়ে। সংখ্যায় একেবারেই কম। দুই চারটা। সেই খারাপ গানগুলো আমাকে আজও তাড়িয়ে বেড়ায়। নিজেকে অপরাধী মনে হয়। একজন শিল্পীর মধ্যে যদি এই তাড়না না থাকে, এই অপরাধবোধ না জাগে, ভালো গানের তৃষ্ণা না থাকে, সম্মানী নিয়ে যদি টেনশন থাকে, তাহলে আর কী বলবো?

অর্থ দু’দিনে চলে যায়। কিন্তু কাজ থেকে যায়। এইটুকু তো আমাদের বুঝতে হবে। আমাদের ইউনাইটেড হতে হবে, এর বিকল্প নেই। কিন্তু প্ল্যানগুলোও করতে হবে তেমন। সবার সঙ্গে আলাপ করে, সিনিয়রদের পরামর্শ নিয়ে এগোতে হবে। ঠিক এই দাবিটাই ওরা আরও সুন্দর করে উপস্থাপন করতে পারতো, একটু সময় নিয়ে। কিন্তু সেটা তো হলো না। তাদের তো দেখছি অনেক তাড়াহুড়ো।

এটাও সত্যি, যে কোনও ইউনিটিতে লিডারশিপ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গবন্ধুর দেশে লিডারশিপ বিষয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। এটুকু বলি, সঠিক নেতৃত্বের ভুলে অনেক ভালো উদ্যোগ নষ্ট হয়।

 

দেশে যতগুলো উল্লেখযোগ্য রিয়েলিটি শো হয়েছে, তার বেশিরভাগের সঙ্গে আমার সরাসরি সম্পৃক্ততা ছিলো। আছে এখনও। ভীষণ কষ্ট পাবো, আমার এই সন্তানতুল্য শিল্পীরা যদি ভুল আদর্শে পা বাড়ায়। আমি এখনও বিশ্বাস করি, বিভিন্ন রিয়েলিটি শো থেকে উঠে আসা এই তরুণরাই মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির হাল ধরবে শক্ত হাতে।

আমি অনুরোধ করবো, সংগীতের এই ইউনিটির দরকার আছে। এটা খুবই গুড সাইন। কিন্তু সেটিকে পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে। কারণ শিল্পীরা এক হয়ে চলার রেকর্ড এই দেশে নেই। কারণও আছে। নাটক-সিনেমায় খেয়াল করবেন প্রতিটা বিভাগের একটা করে ইউনিটি আছে। অথচ মিউজিকে কিছু নেই। বহু চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছু হয়নি। কারণ, একজন সাবিনা ইয়াসমীন বা রুনা লায়লার কথাই ধরি। এই মানুষগুলো একাই একটি মঞ্চে টানা দুই তিন ঘণ্টা গান করেন। তাদের সামনে সরাসরি থাকে হাজার থেকে লাখো মানুষ। একজন মানুষ গেয়ে ওঠেন, সামনে জনসমুদ্র ঢেউ খেলে। একজন সংগীতশিল্পী কত বড় ক্ষমতাধর, জাস্ট ইম্যাজিন। এর ফলে মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে আসলে আমরা সবাই যার যার অবস্থানে অনেকটাই ওয়ান ম্যান আর্মির মতো। এসব কারণেই আমরা ইউনাইটেড হতে পারিনি, এটা আমার অবজারভেশন।

 

ফলে আমি চাই, সংগীতের তরুণদের এই ইউনিটিটা থাকুক। কিন্তু এভাবে নয়। এখনই সময়, নিজেদের ইউনাইটেড হওয়ার। আমি ওদের জন্য আছি। ওদের যা লাগে আমি পাশে থাকবো। বাট এটাকে হাস্যকর করে ফেলা যাবে না। আমাদের ইন্ডাস্ট্রির প্রথম জটিলতা, কপিরাইট আর রয়্যালটি। শুধু এই কারণে, আমাদের শিল্পী, গীতিকার, সুরকারদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়। অথচ আমরা একই মায়ের পেটের ভাই-বোন। ফলে এসব সিরিয়াস ইস্যুর একটা সুরাহা করা দরকার। সেটার জন্য আমাদের সবাইকে এক হতে হবে। নেতাগিরি নয়, শিল্পীসুলভ আচরণের মধ্যদিয়ে আমাদের ঘরের নিয়ম-কানুনগুলো ঠিক করতে হবে।

কিন্তু সেটি করতে গিয়ে আবার, ডেসপারেট হওয়া যাবে না। শিল্পীসুলভ আচরণ থেকে বেরিয়ে পড়া যাবে না। পয়সার জন্য পাবলিকলি মারামারি করা যাবে না।

 

ইংরেজিতে দুটি কথা আছে, ‘লংগার অ্যাবসেন্স ফর বেটার কেয়ার’ এবং ‘আউট অব সাইট আউট অব মাইন্ড’—এই দুটি বিষয় আমাদের মানতে হবে। আমি মাসে টিভি পর্দায় কয়বার যাবো, কয়টা গান-ভিডিও প্রকাশ করবো, কয়টা ইন্টারভিউ দেবো, কী গান গাইবো, কোথায় কোনটা পরিবেশন করবো—এর সবকিছুর সমন্বয় করতে হবে। পকেট খরচা দিলো আর দৌড়ে গিয়ে গান গেয়ে দিলাম—হবে না। আবার কেউ ফ্রি অফার করলে, দল বেঁধে গালি দেবো—সেটাও অন্যায়। এটুকু বোধ নেই কেন—আমাকে কেউ ফ্রি অফার করার মানেটাই হচ্ছে, আমি নিজের অর্থমূল্য নির্ধারণ করতে পারিনি। সিম্পল। আর সেই ব্যর্থতার কথাই ঢাক বাজিয়ে আমরা জানালাম! এবং সেটাও আমাকে জীবদ্দশায় দেখে যেতে হচ্ছে। এখন মনে হচ্ছে, বাচ্চু আগে আগে চলে গিয়ে, বেঁচে গেল! কারণ, ইন্ডাস্ট্রির অনিয়মগুলো ওকে আর দেখতে হচ্ছে না।

এতক্ষণ যে কথাগুলো বললাম, সবই আমার ব্যক্তিগত জীবনবোধ থেকে। একটি অক্ষরও নিজেকে জাহির করার জন্য বলিনি। এই বয়সে এসে, নিজেকে জাহির করার মতো তেমন কিছু নেইও। আমার সবটুকুই সবার জানা। সম্মানী ইস্যুতে যে জোট হয়েছে, সেটি নিয়ে কারোর প্রতি আমার ব্যক্তিগত কোনও আক্রোশ নেই। বরং এই প্রজন্মের প্রায় প্রতিটি ছেলেমেয়ের প্রতি আমি টান অনুভব করি। সবার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত আলাপ আছে।

কিন্তু এই ছেলেমেয়েদের আমি এভাবে দেখতে চাইনি। অধিক ভরসা করলে যা হয়, সেটাই হয়েছে হয়তো।

 

একটাই অনুরোধ—বি ইউনাইটেড, বি স্মার্ট। নিজের শিল্পী সত্তাকে বিকিয়ে দিও না। এই বাংলার গান আর ঐতিহ্য তোমাদেরই টেনে নিতে হবে বাকিটা পথ।

 

লেখক: সংগীত ব্যক্তিত্ব






মতামত দিন।

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*