শিল্পীর সাথে সাথে কি বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রেরও ক্ষমা চাওয়া উচিত নয়?
ভারতীয় উপমহাদেশের জাতে নমশূদ্র হিন্দু ধর্মের অকুলিন গোষ্ঠীর বেশিরভাগ জনগোষ্ঠী কুলিন হিন্দুদের অত্যাচার আর অভাব থেকে বাঁচতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে জাতে উঠেছিল শুধুমাত্র জাতপাতের ভেদাভেদ থেকে নিজস্ব পরিচয় খুঁজে পেতে। অথচ, আজ সেই পরিচয় ভুলে আমরা নিজেকে যতটুকু ধর্ম দিয়ে চিনেতে শিখেছি ঠিক ততটাই মানুষকে মানুষ ভাবতে শিখেনি!
আউলবাউল লালনের দেশে আজ শিল্পকলা আর শিল্পীর গান যতটা না মানুষকে উদ্বেলিত করে ঠিক ততটাই অনুভূতিকে অবদমিত করে একদল মানুষরূপী হায়েনার সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে।
ইসলাম শান্তির ধর্ম এটা জেনেই বড় হয়েছি এবং সেই ধর্মের একজন অনুসারী হিসাবে লজ্জাবোধ করছি এজন্য যে, ধর্মের নামে চালিত সহিংসতার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে প্রতিবাদ করার মতো খুব কম সংখ্যাক মুসলমান আছে। কেউ এসবের প্রতিবাদ করলে নিজের ঈমান না গেলেও সামাজিকভাবে চিহ্নিত হওয়ার ভয়ে বেশিরভাগই চুপচাপ থেকে উটপাখির জীবন বেছে নিতে পছন্দ করে। ধর্ম সম্পর্কে বাস্তব জ্ঞানের চর্চা তো দূরে থাক সেটা পালন না করলেও একদল দাঁত খিচিয়ে ছুটে আসে ধর্ম গেল বলে আর একদল ধর্ম স্পর্শকাতর বিষয় বলে এড়িয়ে যায়। যদি সমালোচনার মুখে নিজের ধর্ম ছুটে যায়?
বাংলাদশের আনাচকানাচে যেভাবে ধর্ম ব্যবসায়ী পীর আর ছেপারা হুজুরের আহাজারি তাতে সাধারনের ধর্ম প্রায়শই এসপারওসপার হওয়ার জোগাড় হয়। কেউ যদি বলে কলিম মৌলভী এটা বলেছে তো আরেকজন বলবে রহিম মৌলভী অন্যটা বলেছে আবার অমুক পীর এটা বলেছে তো তমুক পীর ঐটা বলেছে এবং কারটা সঠিক তা নির্ণয়ের আগেই আমপারা আর কায়দা হুজুরের দলবল মারামারির মহোৎসবে জড়িয়ে যাবে কিন্তু কোরান কিম্বা সহীহ হাদিসে কি লিপিবদ্ধ আছে তা যাচাইয়ের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করবেনা। তাছাড়া, হটাৎ আমদানি হওয়ায় বাবাদের অনুসারী কিংবা সেই বাবাদের কথাবার্তাই এমনকিছু উদ্ভট বিকৃতি উল্লেখ্য হয় তা মুখে না নেওয়াই একজন মুসলমানের ঈমান রক্ষার অন্যতম উপায় বিবেচিত হবে।
একজন আটরশি বাবা তো আরেকজন ষোলরশি বাবা আবার একজন সায়দাবাদি তো আরেকজন দেওয়ানবাগী এবং তাদের বাগ্মিতা এতটাই খুরধাঁর যে একজন তো সরাসরি আল্লাহর সাথেই কথা বলে সমস্যার সমাধান করে ফেলতে ওস্তাদ। আবার নবী মোহাম্মদের গায়ের ময়লা পরিস্কার করে দিয়ে ইসলামের নবুওয়াত লাভের সাথে সাথে নবী কন্যা ফাতেমাকে বিয়ে করেছেন বলে স্বগতোক্তি করলেও তথাকথিত ধর্ম ব্যবসায়ী ও তাদের পৃষ্ঠপোষক ও অনুসারী নব্য হেফাজতে আউলিয়াগণের ধর্মীয় অনুভূতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়না এবং অনলাইন বা অফলাইনে ঈমান রক্ষার তোড়জোড় শুরু করে বেহেশতের টিকিট কনফার্ম করার মাজেজাও পরিলক্ষিত হয়না। কিন্তু সেসব ধর্ম ব্যবসায়ী ও তাদের কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি করতে দুকলম লিখলে কিংবা বললে একদল ঈমান আঁকিদার বর্গাদার ছুটে আসবে যে তাতে নিজের বিশ্বাস পালিয়ে যাবার জোগাড় এবং এই ভণ্ডের তাবেদাররা যেকোনভাবেই আপনাকে নাস্তিক প্রমাণের ঠিকাদার নিয়ে নিবে। যেন, লেখক বা গায়কের নাস্তিকতায় নিজের ঈমানী শক্তি হারিয়ে যাওয়া থেকে উদ্ধার পাওয়ার সাথে সাথে নিজের আকামের সলতেটা পূতপবিত্র রূপ ফিরে পায়।
পথেঘাটে হরহামেশাই একদল স্বাধীনতার বিরোধী অপশক্তি নিজেদের সাচ্চা মুসলমান দাবি করে পাকীদের মতো সহীহ্ মমিন হতে হেন কোন গালিগালাজ নেই যা তাদের মুখে নিঃসৃত হয়না। ইসলামের দৃষ্টিতে গালিগালাজ করলে নাকি মুখ অপবিত্র হয়ে যায় এবং সেই মুখে এবাদত হয়না যতক্ষণ না তওবা করে স্রষ্টার নৈকট্যলাভ হয় বা একটা নির্দিষ্ট সময় পার না হয় কিন্তু এসব ঈমানী জোশে বলিয়ান পাঁঠার দল যেভাবে গালিগালাজ করেন তাতে কার ঈমান রক্ষা হবে তা নির্ণয়ে স্বয়ং স্রষ্টা নিজেও সন্দিহান হয়ে পড়েন বলেই বিশ্বাস।
সারাক্ষণ অফলাইন কিংবা অফলাইনে ফতোয়াবাজের মচ্ছব তো চলতেই আছে। ওয়াজ নসিহতের উছিলায় একদল জোব্বাধারী বছরব্যাপী ফতোয়াটাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকেন আর ফতোয়া দিতে না পারলে এসব হুজুরদের কদর কমে যাবে বলেই তেনারা বিশ্বাস করেন আর তাইতো নিজেদের কাঁটতি বাড়াতে প্রয়োজনীয় না হলেও কয়েকটা ফতোয়া দেওয়া লাগবেই তাতে ধর্ম থাক বা যাক। অথচ, নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ আছে কে, কখন এবং কি পরিস্থিতিতে ফতোয়া দিতে পারবে এবং কাদের কোরান, হাদিস, ইজমা ও কিয়াসের আলোকে কাদের দ্বারা স্বীকৃতি পাবে। অর্থাৎ যেকেউ চাইলেই যখনতখন ফতোয়া দেবার অধিকার রাখেনা যা প্রকৃত ইসলামের মৌলিক স্বীকৃত পণ্হা বলে বিবেচিত। তারপরও যখনই কেউ সুযোগ পাচ্ছে বা তার মতের সাথে অমিল হচ্ছে তখনই একজনকে নাস্তিক ঘোষণা করেই ক্ষান্ত হচ্ছেনা বরং তাকে নির্দিষ্ট গ্রুপ কিংবা নিজের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ওয়ালে সহমত ভাই বলা মমিনদের ট্যাগ করে নিজের ও অন্যান্যদের ঈমানদার হওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে।
বুদ্ধিজ্ঞান হওয়ার পর থেকেই ব্লাসফেমী আইনের জন্য একদল দেখি সবচেয়ে উচ্চকিত থাকে এবং ধর্মীয় সভা সমাবেশে জ্বালাময়ী বক্তব্য দিয়ে নিজের সাথে সাথে উপস্থিত শ্রোতাদের ঈমান আঁকিদার হেফাজত করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে কার্পণ্য করেননা কিন্তু একই সমাবেশে যেভাবে অনান্য ধর্ম সম্পর্কে কটুবাক্য ছুড়ে দেন তাতে ব্লাসফেমী আইনের সুযোগ থাকলে সেই অপরাধে নিশ্চিতভাবে তার ফাঁসির দড়ি গলায় পরতে হতো। যদিও তেনারা বিশ্বাস করেন ব্লাসফেমী আইনের ধার শুধু অন্য ধর্মের লোকেদেরকে ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ বা ঘৃণা রুখতে কার্যকরী হবে কিন্তু ব্লাসফেমী আইন মানেই যেকোনো ধর্ম নিয়ে কটুবাক্য ছুড়ে দেওয়াদের বিরুদ্ধে হওয়ার কথা।
ধর্ম নিয়ে কটুবাক্য ছুড়ে দিলে ধর্ম কি চলে যায় বা সেই ধর্মের গায়ে কতটুকুই আঁচড় পড়ে তা কি আমরা একবারো ভেবে দেখেছি? নিশ্চয়ই ভেবে দেখেনি কিংবা দেখার প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করতে শিখেনি বলেই ধর্মের নামে নিজেরা উম্মাদের মতো আচরণ করছি। একজন বাউল শিল্পী তার গানে আবহমান বাংলার ইতিহাসের কথা ফুটিয়ে তুলতে গেয়েছেন-
আমরা কি শুধুই আলিফ লাম মিম পড়বো?
না, আমরা একই সাথে হাট্টিমা টিম টিম পড়বো।
আরবির সাথে সাথে আমাদেরকে বাংলাও পড়তে হবে যা তিনি সুরের মাধ্যমে তুলে ধরেছিলেন কিন্তু নব্য হেফাজতে আউলিয়ার উত্তরসূরিদের কাছে সেটা ধর্ম অনুভূতি হয়ে ঈমানের সলতে জ্বালিয়ে দিয়েছে বলেই নিজেদেরকে ঠিক রাখতে পারেননি। উন্নয়ন মেলার আয়োজনে উপস্থিত জনসমক্ষে তার প্রতি ছুটে গিয়ে আক্রমণ করা হয়েছে এবং পুলিশ তাকে উদ্ধার করে থানায় আটকে রাখে। পরিস্থিতি বিবেচনায় হয়তো পুলিশকে ভূমিকা নিতে হয় কিন্তু উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পুলিশের ভূমিকা কি শুধুই ভিকটিমদের জন্য সীমাবদ্ধ?
আমরা দেখতে পেলাম থানায় আটকে রাখার পর সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে প্রকাশ্যে হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়ে মুচলেকা দিয়ে তওবা পড়ে শিল্পীকে ছেড়ে দেওয়া হলো কিন্তু ঘটনার সময় যেসকল মাদ্রাসার শিক্ষক ও ছাত্ররা জড়িয়ে ছিল তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হলো না। তাহলে কি রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে কোন দায়িত্বশীল আচরণ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব হয়না?
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় প্রকাশ্য দিবালোকে একের পর এক ধর্মীয় উগ্রপন্থী আচরণ করা হচ্ছে কিন্তু বিশেষ কোন মহলের সুবিধার্থে তার সঠিক কোন বিচার করা ও অপরাধীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নেওয়ার প্রয়োজন কেন পড়ছেনা তা কি কর্তৃপক্ষ ব্যাখ্যা দিবেন? ধর্মীয় উম্মাদনার সৃষ্টির পেছনে কারা জড়িত এবং কি জন্য বারবার সেখানেই সংঘবদ্ধ হামলা হচ্ছে তা কি রাষ্ট্রের ধর্তব্যের মধ্যে আছে?
এর আগেও বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ এর স্মৃতিজড়ানো প্রতিষ্ঠান ও জাদুঘরে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির জন্যে দায়ীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কিনা তাও অজানা রয়ে যাচ্ছে।
রাষ্ট্রের একজন নাগরিকের জানমাল রক্ষা ও তাকে হেফাজত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব কিন্তু একজন শিল্পী লেখক, ব্লগার কিংবা নাগরিকের ব্যক্তি স্বাধীনতা বা চলাচলের স্বাধীনতা সংকুচিত করতে যখন ধর্মীয় উম্মাদনার সৃষ্টি হয় তখন তা মোকাবেলার দায়িত্বও রাষ্ট্রের উপর পড়ে। একজন লেখক, শিল্পী কিংবা মুক্তমতের অসাম্প্রদায়িক চেতনাবোধ সম্পন্ন মানুষ যখন আক্রান্ত হয় তখন একটি জাতি রাষ্ট্র হিসাবে রাষ্ট্রও আক্রমণের স্বীকার হয় এবং সেই আক্রান্ত ব্যক্তির ক্ষমা চাওয়ার সাথে সাথে রাষ্ট্রেরও ক্ষমা চাওয়া উচিত তার দায়িত্বশীল আচরণ করার ব্যর্থতার জন্য আর তা না হলে ধীরে ধীরে রাষ্ট্রও পতিত হয় অন্ধকারের হাইওয়েতে যেখান থেকে স্বাভাবিকভাবেই বের হওয়ার পথ সংকুচিত হয়ে যায়।