বাইরের নয়, আওয়ামীলীগ’কে ভিতরে’র শত্রুর প্রতি খেয়াল রাখতে হবে।।

আবদুল গাফফার চৌধুরী।।
সিলেটের পুলিশ কর্তৃপক্ষ কাজটা ভালো করল বলে মনে হয় না। ২৩ অক্টোবর সিলেটে নবগঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সমাবেশ করার কথা। পুলিশ এই সমাবেশের অনুমতি দেয়নি। পরবর্তী দু’একদিনে দেবে কিনা, তাও এখন পর্যন্ত জানি না। ফ্রন্টের পক্ষ থেকে আ স ম আবদুল রব জানিয়েছেন, তারা সমাবেশ করতে না পারলেও সিলেটে যাবেন এবং হজরত শাহজালালের মাজার জিয়ারত করবেন। পুলিশ যদি তাতেও বাধা দেয়, তাহলে ছোটখাটো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে পারে বলে আমার আশঙ্কা।
কী কারণে ২৩ অক্টোবরের এই সমাবেশ করতে দেওয়া হলো না? শান্তিভঙ্গ হওয়ার আশঙ্কায় কি? ঐক্যফ্রন্ট মাঠে নামার শুরুতেই শান্তি-শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে তাদের আসল চেহারাটা বেরিয়ে পড়ত। আর শান্তি-শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে তাতে বাধা দেওয়ার জন্য দক্ষ পুলিশ বাহিনী তো আছেই। একটি সাধারণ নির্বাচনের আগে বিরোধী দল বা জোটকে সভা-সমাবেশ করার ব্যাপারে বিধিনিষেধ এমনিতেই শিথিল করা হয়। সিলেটে ঐক্যফ্রন্টকে এই সমাবেশ করতে দিলে কোনো ক্ষতি হতো বলে মনে হয় না।
এখন সরকার অহেতুক দুর্নাম কামাবে। প্রচার করা হবে, নির্বাচন সামনে রেখেও সরকার বিরোধীদলীয় জোটকে সভা-সমাবেশ করতে দিচ্ছে না। দিলে কী হতো? এর আগে বিএনপি জোট এককভাবে ঢাকায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করেছে। দু’দিন জেলা শহরে কর্মসূচি পালন করেছে। তাতে বিএনপি এমন কোনো শক্তি প্রদর্শন করতে পারেনি যে, সরকার তাকে গণনায় ধরতে পারে।
সিলেটের জনসভায় নতুন কী হতো? যদিও বলা হয়েছে, এটা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সভা। আসলে তা বিএনপি-জামায়াত জোটের সভা। বিকল্পধারা, শ্রমিক কৃষক লীগ এই ঐক্যফ্রন্টে নেই। ড. কামাল হোসেন এবং রব ও মান্না ফ্রন্টে এসেছেন তাদের ব্যক্তিগত পরিচয়েই মূলত। তাদের দলগুলো নাম-সর্বস্ব। বিএনপির ২০ দলীয় জোটে তাদের যোগদান তাতে আরেকটি ছোট দলের সংযোজন। তার বেশি কিছু নয়। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট এই গালভরা নামের আড়ালে এটি আসলে বিএনপি-জামায়াত জোট।
সাম্প্রতিককালেও প্রমাণিত হয়েছে, এই জোটের আন্দোলন করার মতো জনসমর্থন ও শক্তি নেই। তবে বিশাল জনসভা করার মতো সক্ষমতা আছে। এ যুগে বিশাল জনসভা করা কোনো ব্যাপার নয়। টাকা থাকলেই হলো। বিএনপির জনসভায় রেন্টেড ক্রাউড, জামায়াতের ক্যাডেট ও কর্মীদের বিপুল সংখ্যায় যোগদান এখন তো একটি ওপেন সিক্রেট। এটা নিয়ে আওয়ামী লীগের চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। সিলেটের জনসমাবেশটি যদি হয় (এখনও যদি পুলিশ কর্তৃপক্ষ অনুমতি দেয়), তাহলে বোঝা যেত ঐক্যফ্রন্টের আসল মুরোদ কতটা?
সবার অংশগ্রহণে আওয়ামী লীগ একটি অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন করতে চাইলে বিএনপি-জামায়াত তথা ঐক্যফ্রন্টের অবাস্তব কোনো দাবি তাদের মেনে নেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। দরকার আছে সন্ত্রাস দমনের জন্য যে নাগরিক অধিকারগুলো ইদানীং কিছুটা সংকুচিত করা হয়েছিল, সেগুলো আবার সম্প্রসারিত করার। একমাত্র শান্তি ভঙ্গকারী ও উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রচারে বাধা প্রদান করা ছাড়া নির্বাচন সম্পর্কিত আর কোনো প্রচার-প্রোপাগান্ডায় বাধা দেওয়া উচিত নয়। মালয়েশিয়ার মাহাথির সম্প্রতি বলেছেন, ‘গণতন্ত্রের ধর্ম হচ্ছে সমালোচনা সহ্য করা।’ বাংলাদেশের শেখ হাসিনা তো শুধু সমালোচনা নয়, তার বিরুদ্ধে অনেক মিথ্যা প্রচার, এমনকি তার জীবনের ওপর হামলা পর্যন্ত সহ্য করেছেন।
বাংলাদেশের একশ্রেণির বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিক দেশে বাকস্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নেই বলে প্রচার চালান এবং টেলিভিশনে ও সংবাদপত্রে নির্বিবাদে সরকারবিরোধী অভিযোগ তোলেন। তারা বিদেশেও প্রচার করেন, বাংলাদেশে সাংবাদিকরা নির্যাতিত। সম্প্রতি তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি দূতাবাসে এসে বিদেশে আশ্রয় গ্রহণকারী সৌদি সাংবাদিক খাস্তোগির ভাগ্যে কী নির্মম পরিণতি ঘটেছে, তা দেখে বাংলাদেশে এই বিশেষ শ্রেণির সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন সাংবাদিক নির্যাতন কাকে বলে? বাংলাদেশে এই নির্যাতন আছে কিনা?
দেশে উন্নয়নের অর্থনীতি থেকে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সরকারের যে অর্জন, তাতে বিএনপি-জামায়াত জোট বা তাদের নতুন মুখোশ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে ভয় করার কিছু নেই। আওয়ামী লীগের যদি ভয় করার কিছু থাকে তা হলো, তাদের অভ্যন্তরীণ অবস্থা, দলে একশ্রেণির নবাগতের আধিপত্য ও দৌরাত্ম্য এবং একশ্রেণির এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান ও নেতার অবাধ দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার। এ ব্যাপারে কয়েকজন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী এবং এমপির নামও সামনে চলে এসেছে। আগামী নির্বাচনে এ ধরনের ব্যক্তিরা যদি মনোনয়ন লাভ থেকে বাদ না পড়েন এবং সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিরা, বিশেষ করে জনগণের পছন্দের লোকেরা মনোনয়ন না পান, তাহলে প্রোটেস্ট ভোটের জোরে বিএনপি-জামায়াত জোট আওয়ামী লীগের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। আওয়ামী লীগের জন্য এই সতর্কবাণীটি আগেও উচ্চারণ করেছি এবং এখনও করছি।
আমি আওয়ামী লীগের একজন সামান্য শুভাকাঙ্ক্ষী মাত্র। কিন্তু দেশের মানুষের অনেকের ধারণা, আমি কিছু লিখলেই বুঝি আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড তা শোনেন। তাদের এই ধারণা সত্য নয়। আওয়ামী লীগ হাইকমান্ড তাদের বুদ্ধি-বিবেচনা ও প্রজ্ঞা দ্বারাই চালিত হন। তথাপি পূর্বোক্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে একশ্রেণির মন্ত্রী-এমপি সম্পর্কে অসংখ্য অভিযোগ আমার কাছে পাঠানো হয়।
ইদানীং এই অভিযোগের সংখ্যা বিপুলভাবে বেড়ে যাওয়ায় ভেবেছি, সামনে নির্বাচন। তাই বুঝি আওয়ামী লীগের শত্রুপক্ষ এই সরকারের ক্রেডিবিলিটি ধ্বংস করার জন্য দলটির মন্ত্রী-এমপিদের বিরুদ্ধে এই প্রচার অভিযানে নেমেছে। শত্রুপক্ষের এই অভিযান তো আছেই। কিন্তু একই সঙ্গে যখন দেখি, বিভিন্ন এলাকা থেকে আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাকর্মীরা অনেকে তাদের এলাকার কোনো মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী বা এমপি সম্পর্কে অভিযোগ পাঠান এবং অভিযোগকারীদের সংখ্যা বিরাট, তখন এ সম্পর্কে বিচলিত হতে হয়।
আওয়ামী লীগের অভিযোগকারী নেতাকর্মীদের উচিত, এসব অভিযোগ সত্য হলেও একটি নির্বাচনের আগে তা প্রকাশ করে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট এবং শত্রুপক্ষের হাতে প্রচারণার অস্ত্র তুলে না দিয়ে আওয়ামী লীগ হাইকমান্ডকে তা জানানো। আমার ধারণা, দলের হাইকমান্ড, বিশেষ করে শেখ হাসিনা এসব অভিযোগ সম্পর্কে অবহিত আছেন এবং দলের স্বার্থেই অভিযোগগুলো সঠিক হলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
যেসব মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও এমপি সম্পর্কে আমার কাছেও অভিযোগের স্তূপ জমা হয়েছে, সেসব অভিযোগ একই ধরনের। যেমন তারা পরিবার-পরিজন নিয়ে অবাধ দুর্নীতি করছেন, এলাকায় প্রভাবশালী জামায়াত ও বিএনপি নেতাদের সঙ্গে চুটিয়ে সিন্ডিকেট তৈরি করে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। সাধারণ মানুষের জন্য পাঠানো অর্থ সাহায্য ও অন্যান্য সাহায্য আত্মসাৎ করে রাতারাতি ফেঁপে-ফুলে উঠছেন। আওয়ামী লীগের পুরনো কর্মী ও ত্যাগী নেতারা তাদের কাছে উপেক্ষিত ও নির্যাতিত এবং তাদের প্রশ্রয়ে বিএনপি ও জামায়াতের দুর্বৃত্তদের অত্যাচারে জনজীবন পীড়িত। বিভিন্ন স্থানীয় নির্বাচনে এই শ্রেণির মন্ত্রী, এমপিদের সহযোগিতায় বিএনপি ও জামায়াত প্রার্থীরা নির্বাচিত হয় এবং আওয়ামী প্রার্থীরা ওই এলাকায় পরাজিত হয়।
এই অভিযোগে অভিযুক্ত বেশ কিছু এমপি ও মন্ত্রী। তাদের মধ্যে রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক, রাজবাড়ীর এমপি জিল্লুল হাকিম এবং বৃহত্তর বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ-পাতারহাটের পঙ্কজ দেবের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলোর সংখ্যাই বেশি। রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক সম্পর্কে আমি ইতিপূর্বেও লিখেছি। তার নির্বাচনী এলাকা চৌদ্দগ্রামের চিওড়া ইউনিয়নের শতাধিক ব্যক্তির স্বাক্ষরিত এক অভিযোগপত্র আমার হাতে এসেছে। তাতে তারা মন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন, তিনি দুর্নীতিপরায়ণ। আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ-বিরোধীদের নিয়ে নিজস্ব কোটারি গঠন করেছেন। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে তিনি মনোনয়ন বাণিজ্য করেছেন এবং জেলা পরিষদ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীকে জিতিয়ে এনেছেন। তার এবং তার পরিবার-পরিজনের অত্যাচারে এলাকার জনগণ অতিষ্ঠ।
এই অভিযোগগুলো কতটা সত্য, জানি না। তবে এ ধরনের অভিযোগ যেসব মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও এমপির বিরুদ্ধে রয়েছে, আওয়ামী লীগ হাইকমান্ড নিশ্চয়ই তার যথাযথ তদন্ত করছেন এবং অভিযোগগুলো সত্য হলে তার প্রতিকারের কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার বলেছিলেন, ‘আমি বাইরের শত্রু সম্পর্কে ভীত নই। কিন্তু enemy within (ভেতরের শত্রু) সম্পর্কে শঙ্কিত।’
এ কথা বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সম্পর্কেও সত্য। বিএনপি-জামায়াতের নতুন খোলস ‘জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া’ সম্পর্কে আওয়ামী লীগের শঙ্কা পোষণের কিছু নেই। কিন্তু শঙ্কা পোষণের কারণ রয়েছে ভেতরের শত্রু সম্পর্কে।