প্রাণের ৭১

‘অল্প বিদ্যা ভয়ংকরী’ এই প্রবাদ বাক্যটির যৌক্তিক বিশ্লেষণ

রাসেদ সায়েমঃ ”স্টিফেন হকিং বলেছিলেন,”The greatest enemy of knowledge is not ignorance, it is illusion of knowledge”. অল্প বিদ্যা ভয়ঙ্করী অনেকগুলো কারণে। তার মধ্যে প্রধান এবং সবচেয়ে ভয়ঙ্কর কারণটি হলো, যাদের বিদ্যা বা জ্ঞান অল্প থাকে তাদের আত্মবিশ্বাস থাকে বেশি। তারা এত নিশ্চিয়তার সাথে কথা বলে যে দেখে বোঝার উপায় নেই যে তাদের কথায় কোনো সত্যতা নেই। অথচ যারা প্রকৃত জ্ঞানী তাদের আবার থাকে আত্মবিশ্বাসের অভাব। তাদের কথায় কেমন যেন একটা হীনমন্যতা লক্ষ্য করা যায়। আরও ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো সমাজের মানুষ বাহ্যিক কথা-বার্তা কিংবা রূপ দেখেই মানুষকে যাচাই করে। এজন্যই দেখবেন, আমাদের মানুষ চিনতে সবসময় ভুল হয়। খুব সম্ভবত একই কারণে, আমরা ভুল মানুষের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলি।

 

কিন্তু, এমনটা হওয়ার কারণ কি? এর ব্যাখ্যা প্রথম দেয় ডেভিড ডানিং এবং জাস্টিন ক্রুগার নামক দুই সোস্যাল সাইকোলজিস্ট। তাদের নামের সাথে মিল রেখে এই সাইকোলজিক্যাল ফেনোমেনার নাম রাখা হয় ডানিং-ক্রুগার ইফেক্ট। ১৯৯৯ সালে তারা একটি পরীক্ষা চালান। পরীক্ষাটিতে নানা শ্রেণী পেশার মানুষ অনশগ্রহণ করেছিল। অংশগ্রহণকারীদের একটি অবজেক্টিভ টাস্ক এবং একটি সেল্ফ এসেসমেন্ট টেস্ট দেয়া হয়েছিল। অর্থাৎ, প্রথমে অবজেকটিভ টাস্ক নেয়া হয়, পরে প্রত্যেক অংশগ্রহণকারীর থেকে জানতে চাওয়া হয় তারা অবজেকটিভ টাস্কে কেমন করেছে। অতঃপর অবজেক্টিভ টাস্ক ও সেল্ফ এসেসমেন্ট টেস্ট তুলনা করে ডানিং এই সিদ্ধান্তে পৌছান যে যাদের স্কোর অবজেক্টিভ টাস্কে সবচেয়ে নিচের ২৫% এ ছিল, তারা সেল্ফ এসেসমেন্ট টেস্টে নিজেদের সবচেয়ে উপরের ২৫% এ রেখেছে। এ থেকে প্রমাণিত হয় যাদের কোনো ব্যাপারে সীমিত জ্ঞান থাকে, তারা নিজেদেরকে বিশেষজ্ঞ মনে করে। আর দুঃখজনক হলেও সত্যি যে এই শ্রেণীর মানুষ আমি সবচেয়ে বেশি দেখেছি বাংলাদেশের পাবলিক ভার্সিটিগুলোতে।

 

নিম্নে একটি গ্রাফ দ্বারা ডানিং-ক্রুগার ইফেক্টটি বুঝানো হলোঃ

 

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আমরা এই ডানিং-ক্রুগার ইফেক্টের প্রমাণ পাই। আমরা যখন কোনো কিছু সম্পর্কে হালকা ধারণা পাই আমাদের কাছে খুব সহজ মনে হয়। কিন্তু যখন আমরা এর গভীরে যাই তখন মনে হয় এ তো অনেক কঠিন, আমার দ্বারা এটা সম্ভব না। কিন্তু আমরা যদি লেগে থাকি, ধীরে ধীরে জিনিসটা সহজ হয়ে যায়।

 

ডানিং-ক্রুগার ইফেক্ট থেকে শিক্ষণীয় বিষয়ঃ

 

(১) কারো বড় বড় কথার উপর ভিত্তি করে তাকে বিচার করা উচিত না, বরং তার কাজ দেখে তাকে বিচার করা উচিত।

 

(২) কোনো কিছু শিখার ক্ষেত্রে মাঝ পথে গিয়ে যদি মনে হয় এটা কঠিন, আমাকে দিয়ে হবে না; তবুও চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া উচিত। কারণ, যতক্ষণ লেগে থাকবেন জিনিসটা তত সহজ হবে।

জেবিন জান্নাত মনে করেনঃ কোনোকিছু সম্পর্কে পর্যাপ্ত ধারণা না থাকলে তা সম্পর্কে অনেক জানি এমন ভাবা বা অন্যের সাথে তর্কে লাগা যে এ সম্পর্কে অধিক জানে

রাসেল আহম্মেদ জয়ঃ সব জিনিস এবং বিষয়ের মর্যাদা সব মানুষের বোঝার ক্ষমতা বা দক্ষতা থাকে না। যথাযথ স্থানে যথাযোগ্য ব্যক্তি অধিষ্ঠিত না হলে সত্য, সুন্দর, মঙ্গল একেবারে ধুলিষ্মাৎ হয়। সেখানে স্হান করে নেয় যেন অত্যাচার, জুলুম আর দুর্নীতি।সুুতরাং জীবনকে সুুুন্দর ও শোভন রূপে গড়ে তোলা না হলে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বা সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হওয়া যায় না।

 

এজন্য মানব জীবনে যেন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন জ্ঞানের। জ্ঞানই শক্তি আর জ্ঞানেই মুক্তি। কারণ, জীবন যাপনে সকল মানুষকে হাজারো সমস্যা মোকাবিলা করেই ‘সম্মুখে অগ্রসর’ হতে হয়। আপন জন্মের ব্যাপারেই মানুষের নিজের কোনো ভূমিকা থাকে না। উঁচু বা নিচু, ধনী বা দরিদ্র পরিবারে তার জন্ম হওয়াই যেন তার ইচ্ছা ও কর্মের ওপর নির্ভর করে না।

 

কিন্তু কর্ম জীবনে তার ভূমিকা এবং অবদানের দায় তার নিজের উপর বর্তায়। এই পৃথিবীতে মানুষের প্রকৃত বিচারে তার জন্ম-পরিচয় তেমন গুরুত্ব বহন করে না বলেই মনে করি। বরং মানুষ কর্ম-অবদানের মাধ্যমেই পেয়ে থাকে বহু মর্যাদার স্হান বা আসন এবং হয়ে যান একে বারেই বরণীয়-স্মরণীয়।

 

পক্ষান্তরে আবার বলা যায়, এমন সমাজে এক দল লোক রয়েছে, যারা কি না তাদেরই বংশ আভিজাত্যে নিজেদের জ্ঞানী এবং সম্ভ্রান্ত মনে করে। তারা বংশ মর্যাদার অজু হাতে সমাজে বিশেষ মর্যাদা দাবিও করে। সুতরাং- এমন আলোচনার মুল উদ্দেশ্যটা হলো অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্কর বা ভয়ঙ্করী।

 

অতি জ্ঞানী ভাবধরা গোবরে পোকার পাণ্ডিত্যেরই কিঞ্চিৎ বিশ্লেষণ মাত্র। অল্পবিদ্যা অর্থ সামান্য লেখা পড়া বা জ্ঞান। আর “অল্প বিদ্যা ভয়ঙ্করী” হচ্ছে সামান্য বিদ্যা ক্ষতিকর, কারণ এতে অহঙ্কার জন্মে, কিন্তু জ্ঞান হয় না। ছোট বেলায় সবাই পড়াশোনায় ব্যবহার করতো অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী (অল্প বিদ্যার গর্ব)।

 

আবার তাকে বাক্য তৈরিতেও নিয়ে যেতো। -“অল্প বিদ্যা ভয়ংকরী বলেই অর্বাচীন- জব্বার মিয়া এ বাংলাদেশের সেরা বৈজ্ঞানিক “ড. কুদরাত-এ-খুদা’র” বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের সমালোচনায় অগ্রসর হয়েছিল। সুতরাং সে সব মানুষের প্রয়াস বাস্তবতা বিবর্জিত ও হাস্যকর। আসলে এখনো সমাজের নিচুতলায় জন্ম নিয়েও তারা কর্ম বা অবদানে বড় কিংবা জ্ঞানী হতে পারছে। মানব সমাজের ইতিহাসে এ রকম উদাহরণ অজস্র।

 

কিন্তু “অল্প বিদ্যা ভয়ঙ্করী” এই প্রবাদটা কম বেশি সকলের জানা থাকলেও প্রয়োগটা কম। ”অল্প বিদ্যা ভয়ঙ্কর বা ভয়ঙ্করী” কথাটি অতি মাত্রায় সত্য।বলতে চাই যে অশিক্ষিত মানুষের চেয়ে অল্পশিক্ষিত মানুষরা সমাজের জন্যে বেশি ক্ষতি কর। অশিক্ষিত মানুষরা কেউ কোন বিষয়ে না জেনে মন্তব্য করে না বা তর্ক করে না। নিজেকে নিয়েও তারা জাহির করে না। পক্ষান্তরেই অল্প অশিক্ষিত মানুষরা যা জানে না তা নিয়ে তর্ক করতে দ্বিধা করেনা। তারা তাদের স্বল্প বিদ্যাকে পুঁজি করে পৃথিবীর সব কিছুকেই পরিমাপ করতে চায় আবার যেন ঠকবাজী করে তা পরিমাপ করেও ফেলে।

 

সকল অল্প শিক্ষিত মানুষকে কটাক্ষ করে এমন এই আলোচনার মুল বিষয় নয়। ‘অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী’ এই প্রবাদ বাক্যটিকে এতদিন কথার কথাতেই যেন দাঁড় করানো হতো৷ কিন্তু মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর উক্তি দ্বারা বুঝা যায় যে, তাঁরও ইতিহাস ও ভিক্তি রয়েছে।তিনি বলেন, আমরা সবাই কম বেশি জানি তা হলো অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী।

 

কিন্তু কেন ভয়ঙ্করী তা জানি না। মানুষদের জ্ঞান-বিজ্ঞানকেই বাড়িয়ে চলার সাধনার ক্ষেত্রে যেন চির দিনই আমিত্বের অহংকার বড় বাধা হয়ে থেকেছে। মানুষ যেটুকু জানেন, তারচেয়ে সেটা বলা এবং জানানোর জন্য ‘চেষ্টা কিংবা গর্ব’ করেন।মনে করে থাকেন যথেষ্ট জ্ঞান অর্জন হয়েছে,- এটাই মানুষের অহংকার কিংবা তার- “নিজস্ব অল্প বিদ্যার অহংকার”।

 

ফলে তার সাথে যুক্তিতে না পেরে অপমানজনক বা বিভ্রান্তকর পরিস্থিতিতে পরা






মতামত দিন।

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*