প্রাণের ৭১

মনোনয়ন চুড়ান্ত হওয়ার পর রাজনৈতিক দৃশ্যপট কি হতে পারে?

মনোনয়ন চূড়ান্ত হওয়ার পর রাজনৈতিক দৃশ্যপট কী হতে পারে?
আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী

মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে উত্তেজনা এখন তুঙ্গে। আওয়ামী লীগ থেকে যাঁরা মনোনয়ন পেয়েছেন অথবা পাচ্ছেন, তাঁদের একটি নামের তালিকা প্রকাশিত হয়েছে। বিএনপির যাঁরা মনোনয়ন পাচ্ছেন, তাঁদের তালিকা এখনো হাতে পাইনি। হয়তো তাও বেরোচ্ছে অথবা বেরোবে। আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রাপ্তদের যে অসম্পূর্ণ তালিকা হাতে পেয়েছি, সেটি সম্ভবত চূড়ান্ত তালিকা নয়। জোটের শরিকদের মধ্যে আসন বণ্টনের পর আওয়ামী জোটের মনোনীত প্রার্থীদের চূড়ান্ত তালিকা জানা যাবে। ঐক্যফ্রন্টের ব্যাপারেও একই কথা।

আমার ভয়টা এখানেই—প্রধান দুটি জোটের মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থীদের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশিত হওয়ার পর একটা বড় তুলকালাম না শুরু হয়। আওয়ামী জোটে এই তুলকালামটা শুরু হওয়ার আশঙ্কাটা কম। নেত্রী হাসিনা আগেই বলে দিয়েছেন, জোটের যাঁরা নমিনেশন পাবেন, তাঁদের পক্ষে অন্য প্রার্থীদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করতে হবে এবং মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতে হবে। নইলে দল থেকে সারা জীবনের জন্য বহিষ্কার করা হবে।

আমার ধারণা, এই কঠোর সতর্কীকরণ এবার কিছুটা কাজ করবে। তবে কতটা কাজ করবে তা আমার অনুমানের বাইরে। আওয়ামী লীগেরই কিছু হতাশ প্রার্থী ‘বিদ্রোহী’ হতে পারেন, দল পাল্টানোর চেষ্টা করতে পারেন। কিন্তু এই বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাবে, তা মনে হয় না। এ ছাড়া আওয়ামী জোটের শরিক দলগুলো আসন বণ্টন নিয়ে বেশি হৈচৈ করবে, তার আভাস পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ আওয়ামী জোটের বেশির ভাগ শরিক দলই নীতিভিত্তিক দল। শুধু ক্ষমতায় যাওয়ার লোভে আওয়ামী মহাজোটে আসেনি। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের প্রতি কম হোক আর বেশি হোক এদের একটা আনুগত্য আছে।

কিন্তু ঐক্যফ্রন্টের বেলায় এ কথা সত্য নয়। ঐক্যফ্রন্টের ঐক্য নীতিভিত্তিক নয়, ক্ষমতাভিত্তিক। বিভিন্ন মতের, বিভিন্ন গোত্রের—এমনকি পরস্পরের বিপরীত দল-মতের লোকরাও এই ফ্রন্টে এসে জড়ো হয়েছেন। তাঁদের একমাত্র লক্ষ্য হাসিনা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দলগুলোকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ এবং যেভাবে হোক ক্ষমতা দখল করা। ঐক্যফ্রন্টের বেশির ভাগ দল ও নেতা অতীতে নিজেরা দল গঠন করে ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করে বারবার দেশের মানুষ দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। এখন তাঁরা বিএনপি ও জামায়াতের নিজস্ব বড় ভোট বাক্স আছে জেনে রাতারাতি ভোল পাল্টে ধানের শীষ বুকে ধারণ করে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা আ স ম আবদুর রব সব চক্ষুলজ্জা বিসর্জন দিয়ে নির্বাচনে জামায়াত প্রার্থীর সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচনে নেমেছেন, এটা সম্ভবত এই নির্বাচনের সবচেয়ে বড় প্রহসন।

এটা ড. কামাল হোসেনের জন্যও সত্য। আওয়ামী লীগের সমর্থন ও প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে নেমেও তিনি জয়ী হননি। তাঁর গণফোরামের প্রার্থীদের নির্বাচনে জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর (বর্তমানে আওয়ামী জোটের হয়ে নির্বাচন প্রার্থী ফরাসউদ্দিন তাঁর এক বক্তৃতায় এই বর্ষীয়ান নেতাকে প্রায় উলঙ্গ করে ছেড়েছেন। তাঁর ইহুদি-জামায়াতার কার্যকলাপ সম্পর্কেও ইঙ্গিত করেছেন। ড. কামাল প্রতিবার নির্বাচনে দাঁড়িয়ে কত ভোট পেয়েছেন, তা আঙুলে গুনে দেখিয়েছেন এবং তাঁর জামানত জব্দ হওয়ার কথা বলেছেন।

সম্ভবত এ জন্যই ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা হয়েও ড. কামাল নির্বাচনে দাঁড়াতে চাচ্ছেন না। তাঁকে সাধাসাধি করা হচ্ছে। কিন্তু তিনি দোমনা-দোদিলবান্দা। সম্ভবত অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে ভয় পাচ্ছেন। কিন্তু ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনে যদি জয়ী হয় তাহলে ফ্রন্টের অবস্থা কি রাজা কনিষ্কের মূর্তির মুণ্ডুবিহীন ধড়ের অবস্থা হবে না। তখন দেখা যাবে সংসদীয় নেতা বা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য কর্নেল অলি, আ স ম রব, কাদের সিদ্দিকী (যদি নির্বাচনে দাঁড়াতে পারেন এবং জয়ী হন) ড. জাফরুল্লাহ, বীরবিক্রম হাফিজউদ্দীন প্রমুখ সবার মধ্যে তুমুল লড়াই শুরু হয়েছে। ড. কামাল সামনে না থাকলে এঁরা সবাই প্রধানমন্ত্রী পদের উমেদার। যদিও এই পদের আসল উমেদার তারেক রহমান নেপথ্যে বসে আছেন, অপেক্ষা করছেন।

এসব উৎপাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ড. কামালের উচিত শেষবারের মতো ভাগ্য পরীক্ষার জন্য নির্বাচনে দাঁড়ানো। তাঁর নিজের ভোট না থাক, বিএনপি ও জামায়াতের ভোটে তিনি জয়ী হলে আপত্তি কি! তিনি তো এখন বিএনপি-জামায়াতেরই সিপাহসালার। তবে একটাই ভয়, তিনি নির্বাচনে দাঁড়িয়ে টেনেটুনেও জয়ী হতে পারবেন কি না, আর জয়ী হতে পারলেও তারেক রহমানের কাছে পদ ও নেতৃত্ব ছেড়ে দিয়ে তাঁকে ঘরের ছেলে হয়ে আবার শূন্য হাতে ঘরে ফিরতে হয় কি না। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘নির্বাচনে জয়ী হলে প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, তা নির্ধারণ করবে ফ্রন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠ শরিক—অর্থাৎ বিএনপি। তাহলে এই নির্বাচনে নেমে তাঁর লাভটা হবে কী? শুধু কন্যাসম হাসিনার বিরুদ্ধে প্রতিহিংসা সাধন?

তথাপি এটা নির্বাচনের পরের কথা। নির্বাচনের আগের কথায় ফিরে যাই। আগেই বলেছি, আওয়ামী জোটের মনোনীত প্রার্থীদের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের পর নিরাশ প্রার্থীদের মধ্যে বিদ্রোহ দেখা দিতে পারে। তবে এবারের আভাস হচ্ছে, এটা হবে সীমিত, নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাবে না। কোনো শরিক দল জোট ছাড়বে না। কিন্তু বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের মনোনয়ন তালিকা চূড়ান্ত করা নিয়ে প্রচণ্ড কালবৈশাখীর দেখা দিতে পারে। নীতি ও আদর্শবর্জিত জগাখিচুড়ির ঐক্যফ্রন্টে ভাঙন দেখা দিতে পারে। একাধিক শরিক দল ফ্রন্ট ছাড়তে পারে। এমনকি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে পারে। এটা ঘটবেই তা আমি বলছি না। কিন্তু ঘটার সম্ভাবনাই বেশি। যদি ঘটে, ঐক্যফ্রন্টের অবস্থা হবে রাজা কনিষ্কের মুণ্ডুবিহীন ধড়ের মূর্তির মতো।

আসন্ন নির্বাচনে জয়ের সম্ভাবনা সম্পর্কে ড. কামাল হোসেন নিজেও যে সন্দিহান এবং জয়লাভের জন্য ডেসপারেট তার প্রমাণ মেলে ঐক্যফ্রন্টের পাশাপাশি একটি বুদ্ধিজীবী ফ্রন্ট খোলার জন্য তাঁর প্রয়াস দেখে। দুই কারণে এই ফ্রন্ট তাঁর দরকার। তাঁর ঐক্যফ্রন্ট যে আসলে বিএনপি-জামায়াতের রাজনৈতিক ফ্রন্ট এবং তিনি একাত্তরের পরাজিত শত্রুদের শিবিরেই যোগ দিয়েছেন এটা এখন সাধারণ মানুষের কাছেও এক্সপোজ হয়ে গেছে। এটা তাঁর ভাবমূর্তি দারুণভাবে ক্ষুণ্ন করেছে। ইরাক যুদ্ধের সময় টনি ব্লেয়ারকে যেমন বলা হতো বুশের পুতুল, তেমনি বর্তমানে ড. কামাল হোসেনকে কেউ কেউ বলছেন তারেকের পুডল (Poodle)|

আমার ধারণা, ড. কামালের উদ্দেশ্য এই ভাবমূর্তি ঢাকার জন্য সমমনা ও ভিন্নমনা কিছু বুদ্ধিজীবীকে জড়ো করে তার একটা কাভার তৈরি করা এবং অন্যদিকে যথাসময়ে তাঁর নেতৃত্বের ওপর বিএনপি ও জামায়াতের কোনো আঘাত এলে বুদ্ধিজীবী ফ্রন্টের এই ঢাল দ্বারা তাকে প্রতিহত করা। কিন্তু ড. কামালের এই ইচ্ছাপূরণ হবে কি না সন্দেহ। ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, শাহদীন মালিক এই জাতীয় কিছু এক্সপোজড বুদ্ধিজীবী তাঁর ডাকে সাড়া দিতে পারেন। কিন্তু আকবর আলি খান, সুলতানা কামালসহ স্বাধীনচেতা বুদ্ধিজীবীরা, যাঁরা মাঝেমধ্যে আওয়ামী লীগের সমালোচনা করেন, তাঁরা এই গোয়ালে পা দেবেন, তা আমার বিশ্বাস হয় না। যদি দেন, তাহলে তা হবে আমাদের জাতীয় জীবনের জন্য এক বিরাট ট্র্যাজেডি।

বাম গণতান্ত্রিক জোট কাদের মনোনয়ন দিয়েছে এখন পর্যন্ত তা জানতে পারিনি। তবে অনুমান করতে পারি সংখ্যায় তাঁরা বেশি নন। নিষ্ঠ রাজনৈতিক কর্মী ও সৎ মানুষের সন্ধান তাঁদের মধ্যে পাওয়া যাবে। কিন্তু তাঁদের দু-একজন ছাড়া কেউ ভোট পাবেন মনে হয় না। তার কারণ, এই জোটের শরিক দলগুলোর সাংগঠনিক অবস্থা খুবই দুর্বল এবং তত্ত্বকথার জোরে ভোট পাওয়ার দিন শেষ হয়ে গেছে। সবচেয়ে বড় কথা, দেশের রাজনৈতিক পোলারাইজেশন ঘটেছে দুটি শক্তিশালী ধারায়। সেখানে একটি দুর্বল তৃতীয় পক্ষের মাথা গোঁজার ঠাঁই হবে না।

বিলাতে লেবার পার্টি নির্বাচনে মাঝেমধ্যে জয়ী হয়, তার কারণ, দলটির পেছনে শক্তিশালী ট্রেড ইউনিয়ন আছে। লেবার পার্টিও সাংগঠনিকভাবে অত্যন্ত শক্তিশালী। বাংলাদেশে সিপিবির সেই আগের সুদিন নেই। স্বাধীনতার পর দলটি কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণিকে একাট্টা করে সংগঠনের ভিত্তি শক্তিশালী করতে পারেনি। দলের ছাত্র, শ্রমিক ও সাংস্কৃতিক ফ্রন্টগুলোও অত্যন্ত দুর্বল।

এই অবস্থায় শুধু তাত্ত্বিক অবস্থানকে ভিত্তি করে নির্বাচনে লড়া ও সফল হওয়া হবে কল্পনায় স্বর্গ গড়া এবং দেশের গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক জোটের ভোট কেটে সাম্প্রদায়িক ও গণবিরোধী একটি শিবিরকে ক্ষমতা দখলে সাহায্য করা। ভারতে বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের বারংবার ভুলের জন্য রাষ্ট্রক্ষমতায় হিন্দুত্ববাদী বিজেপির জয়জয়কার থেকে বাংলাদেশের বাম গণতান্ত্রিক জোটের শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত।

বাংলাদেশে নির্বাচন আসন্ন, তাতে মানুষ উৎসবমুখর। কিন্তু অলক্ষে রাজনীতির আকাশে ঝড়-ঝঞ্ঝার মেঘও যে ঘনাচ্ছে তাকে উপেক্ষা করা ঠিক হবে না। অপেক্ষায় আছি, আওয়ামী মহাজোট ও ঐক্যফ্রন্টের চূড়ান্ত মনোনয়ন তালিকা দেখার জন্য। দেখা যাক, কোন জোট কতজন ভালো প্রার্থী দিয়েছে। এবারের নির্বাচনে ভালো প্রার্থীও নির্বাচন জয়ে একটা বড় ফ্যাক্টর হবে।






মতামত দিন।

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*