প্রাণের ৭১

আজ স্বৈরাচার পতন ও গণতন্ত্র মুক্তি দিবস

মোহাম্মদ হাসান: আজ ৬ ডিসেম্বর, স্বৈরাচার পতন ও গণতন্ত্র মুক্তি দিবস। দীর্ঘ নয় বছরের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে প্রাণ হারান নূর হোসেন, সেলিম, দেলোয়ার, কঞ্চন,ময়েজ উদ্দিন, রায়ফুন বসুনিয়া, দিপালী সাহা, তাজুল, ডাঃ মিলন, নূরুল হুদা, বাবুল, ফাত্তাহসহ অসংখ্য নেতাকর্মী। আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে গণঅভ্যুত্থানের মুখে ১৯৯০ সালের এ দিনটিতে পতন ঘটে ক্ষমতাসীন এরশাদ সরকারের। এদিন তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধ্য হন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।

২৫ মার্চের কালরাত্রিতে পাকিস্তানি হায়েনারা ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালি জনগোষ্ঠীর ওপর। শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ, গঠিত হয় “মুজিবনগর সরকার”। গ্রেপ্তার হন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বে একটি সফল যুদ্ধ পরিণত লাভ করে আমাদের মুক্তি সংগ্রামে। প্রতিবেশী দেশ ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন আমাদের এই মুক্তিসংগ্রামকে নিঃশর্ত সমর্থন করে। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হলে মিত্রবাহিনী, মুক্তিবাহিনীর সহযোগিতায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে মরণপণ যুদ্ধে লিপ্ত হয়। মুক্তিবাহিনী, মিত্রবাহিনী যৌথ আক্রমনের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি জান্তার সেনাবাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করে। ১৬ ডিসেম্বর রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) আত্মসমর্পণের দলিলে সই করেন জেনারেল নিয়াজী। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর পক্ষে ভারতের জেনারেল জগজিৎ সিং অররা ও মুক্তিবাহিনীর শীর্ষস্থানীয় সেনাপতিরা।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি লন্ডন, দিল্লি হয়ে বঙ্গবন্ধু বিজয়ীর বেশে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। কিন্তু সাড়ে তিন বছরের মাথায় কতিপয় বিপথগামী সেনাকর্মকর্তা, সরকার ও দলের অভ্যন্তরে লুকায়িত ১৯৪৭-এর চেতনায় বিশ্বাসী বিশ্বাস ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে বাংলাদেশকে সামরিকতন্ত্রের বেড়াজালে বন্দী করে।

সামরিকতন্ত্র থেকে মুক্তি লাভের নবতর সংগ্রামের সূচনা হয় সেই সময় থেকেই। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ তৎকালীন সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে জারি করেন নতুন সামরিক শাসন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব রাজনৈতিক দল ও ছাত্রসংগঠন এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলনের সূচনা করে। ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্রসংগ্রামের নেতৃত্বে পরিচালিত ছাত্র-সমাজের আন্দোলনকে জয়নাল, জাফর, মোজাম্মেল কাঞ্চন, দীপালী সাহাসহ অসংখ্য শহীদের বুকের ওপর বুলেট চালিয়ে স্তব্ধ করে দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু মিলিটারির বুটের তলায় পিষ্ঠ হওয়ার জন্য এই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি। ছাত্র-আন্দোলন দিনে দিনে বেগবান হতে থাকে। রাজনৈতিক অঙ্গনেও বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৫ দলীয় ঐক্যজোট গঠিত হয় ও চূড়ান্ত আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পরবর্তী সময়ে গঠিত হয় সাত দলীয় ঐক্যজোট ও সংগ্রামী ছাত্রসমাজ নামের আরেকটি জোট। গড়ে উঠে যুগপৎ আন্দোলন।

১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর শহীদ নূর হোসেনের আত্মদানের মধ্য দিয়ে সেই আন্দোলন তুঙ্গে উঠে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় আপসকামিতা ও বিভেদের মাধ্যমে সেই আন্দোলনকে খুনি জান্তা এরশাদ স্থিমিত করে দেয়।

১৯৯০ সালের ১০ অক্টোবর শহীদ জেহাদের লাশকে সামনে নিয়ে সব ছাত্র-সংগঠন (জামায়াত-শিবির ও ধর্মভিত্তিক ছাত্রসংগঠন বাদে) ঐক্য গড়ে তুলে। পরবর্তী সময়ে যার নামকরণ করা হয় সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য। সেখানে ডাকসুও অন্তর্ভুক্ত ছিল। সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের নেতৃত্বে ছাত্রসমাজ অপ্রতিরোধ্য ছাত্র-আন্দোলন গড়ে তোলে। রাজনৈতিক অঙ্গনে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আট দল, পাঁচ দল ও বেগম জিয়ার নেতৃত্বে সাত দলীয় ঐক্যজোট যুগপৎ কর্মসূচির মাধ্যমে আন্দোলন পরিসমাপ্তির দিকে নেয়ার অর্থাৎ সামরিক শাসনের চির অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে একের পর এক কর্মসূচি ঘোষণা করতে থাকে। সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য ১০ দফা কর্মসূচি প্রণয়ন করে। তিন জোট তাদের ঐতিহাসিক রূপরেখা তৈরি করে। উভয় কর্মসূচির সারাংশ ছিল সামরিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশকে পরিচালিত করা। এক কথায় বলা যায়, আমাদের যে ৭২-এর সংবিধানের যে মূল ভিত্তি বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে একটি উন্নত জাতি হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে প্রতিষ্ঠিত করা।

আমাদের এই রক্তক্ষয়ী নয় বছরের আন্দোলনে শহীদ হন রাউফুন বসুনিয়া, শাজাহান সিরাজ, তিতাস, অ্যাডভোকেট ময়েজ উদ্দিন আহমেদ, শ্রমিক নেতা তাজুল, ফিরোজ, জাহাঙ্গীরসহ হাজারো গণতন্ত্রকামী মানুষ। ১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর শহীদ ডা. শামসুল আলম খান মিলনের আত্মদানের মধ্য দিয়ে ছাত্র, শিক্ষক, কর্মচারী, চিকিৎসক, সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মী, আইনজীবী, বুদ্ধিজীবী, সংগ্রামী নারী সমাজ ও শেষ পর্যন্ত সরকারি কর্মকর্তারাও আন্দোলনে সমবেত হন। এক পর্যায়ে জান্তা এরশাদ ১৪৪ ধারা এবং কারফিউ জারি করেন। রাস্তায় সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়। ছাত্র-আন্দোলনে বিভেদ ঘটানো জন্যে খুনি মাস্তানদের জেলখানা থেকে বের করে ছাত্রসমাজের ওপর সশস্ত্র হামলা পরিচালনা করে। কিন্তু ছাত্র-জনতার উত্থাল প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে এরশাদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। একপর্যায়ে সেনাবাহিনীও এরশাদের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নিলে পদত্যাগের ঘোষণা দিতে বাধ্য হয় জান্তা এরশাদ। ৪ ডিসেম্বর পদত্যাগের ঘোষণা দিলেও তা কার্যকরী হয় ৬ ডিসেম্বর। ইতিহাসে কোনো দেশে কোনো স্বৈরশাসকেই দমন-পীড়ন চালিয়ে শেষ পর্যন্ত ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারে নাই। পারেনি বাংলাদেশেও। এরশাদ নিক্ষিপ্ত হয়েছে ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে।

দিবসটি উপলক্ষে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে থাকে। আওয়ামী লীগ দিবসটি গণতন্ত্র মুক্তি দিবস ও স্বৈরাচার পতন দিবস হিসেবে পালন করে থাকে।

এ উপলক্ষে এক বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণতন্ত্রের অতন্দ্রপ্রহরী সংগ্রামী দেশবাসীকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানান। তিনি গণতন্ত্রবিরোধী সকল ষড়যন্ত্রকে প্রতিহত করে গণতন্ত্রের ভিত্তিকে আরও শক্তিশালী করতে এবং দেশের উন্নয়ন ও জনগণের কল্যাণে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত ও সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ গড়ে তোলার আহ্বান জানান।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, নব্বই পরবর্তী তিন দশকে আওয়ামী লীগ গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার রক্ষায় দায়িত্বশীল ভূমিকা রেখেছে। ২০০৯ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনায় দায়িত্ব পেয়ে তার সরকার বিচারহীনতার সংস্কৃতি বন্ধ করে দেশে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, আমরা গণতন্ত্র, সংবিধান, আইনের শাসন ও মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে অঙ্গীকারাবদ্ধ। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে অবৈধ ক্ষমতা দখলের পথ রুদ্ধ হয়েছে। বাংলাদেশে আমরা সপরিবারে জাতির পিতার হত্যার বিচারের রায় কার্যকর করেছি। জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচার সম্পন্ন হয়েছে। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী-মানবতাবিরোধীদের বিচারের রায় কার্যকর হচ্ছে। আদালত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায় প্রদান করেছে।






মতামত দিন।

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*